বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত ও চর্চিত চরিত্র মদন মিত্র। বরাবরি খবরের শিরোণামে থেকেছেন। রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েও ফিরে এসেছেন। তাঁকে নিয়ে দলের অন্দরেও কম জল্পনা তৈরি হয়নি। এমনকি তৃণমূলনেত্রীও নাকি রুষ্ট হয়েছিলেন মদনের প্রতি। তবে সেই সব অতীত ভুলে একুশের নির্বাচনে কামারহাটি থেকে মদনকেই প্রার্থী করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বিধানসভায় এই কেন্দ্র থেকেই ৪,১৯৮ ভোটে হারতে হয়েছিল মদনকে। তখন অবশ্য তিনি সারদা মামলায় জেল বন্দি। তারপর দেখতে দেখতে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। একদা যার সঙ্গে ছিল ইগোর লড়াই সেই শুভেন্দুও আজ দলে নেই। নতুন করে তৃণমূলে গুরুত্বও বাড়তে শুরু করেছে মদনের। এই আবহে একুশে একদা নিজের গড় কামারহাটি থেকে তিনি কামব্যাক করতে পারেন কিনা সেই দিকে নজর সকলের। তবে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা মদন মিত্র নিজের জীবনে বারবার দেখেছেন চড়াই-উতরাই। কেমন ছিল সেই যাত্রাপথ চলুন দেখে নেওয়া যাক।
ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু
১৯৭৩ সালে আশুতোষ কলেজের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হন, সেই শুরু। এরপর দক্ষিণ কলকাতায় ছাত্র পরিষদের সভাপতি। রাজনীতির প্রথম জীবনে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ছিলেন মদন। তারপর সোমেন মিত্র হয়ে মমতাপন্থী। তবে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল প্রতিষ্ঠার শুরুতে নতুন দলে যোগ দানের ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তই ছিলেন মদন। যাইহোক দু'হাজার সালে সেই মদনকেই দলের সাধারণ সম্পাদক করেন মমতা। এর চার বছর পর তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি হন মদন।
শ্রমিক নেতা মদন
১৯৯০ সালে ট্যাক্সি চালকদের ইউনিয়ন শুরু হয়েছিল মদনের হাত ধরেই। এসএসকেএম হাসপাতালে ইউনিয়নও তাঁর অবদান। গত বিধানসভায় হারলেও কামারহাটি জুটমিল , লোহাগেট অঞ্চলে শ্রমিক মহল্লায় তাঁর এখনও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাবকেই এবার ফের একবার নির্বাচনী ভোটবাক্সে কাজে লাগাতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী।
শুভেন্দুর জন্য সরতে হয়েছিল
২০১৪ সালে তমলুক কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু সেই বছরই যুব তৃণমূলের সভাপতির পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে সৌমিত্র খাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কিছুদিন আগেই অবশ্য মমতা ‘যুবা’ নামে সমান্তরাল যুব সংগঠন গড়ে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেন। শোনা যায় সেই থেকেই নাকি ধীরে ধীরে ক্ষোভ জন্মেছিল শুভেন্দুর মনে। যার বহিঃপ্রকাশ ৬ বছর পর দলত্যাগ। কিন্তু এটাও ঠিক শুভেন্দুর জন্য সরতে হয়েছিল মদনকেও। ২০০৮ সালেই মদন মিত্রের জায়গায় শুভেন্দুকে যুব তৃণমূলের সভাপতি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা ছয় বছর সেই পদে ছিলেন শুভেন্দু। তাই শুভেন্দু দল ছাড়তেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে মদন মিত্রকে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দলে একরকম কোণঠাসা হয়েই ছিলেন তিনি। তাই হারান জমি ফিরে পেতে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই তাঁকে আক্রমণে বিঁধতে শুরু করেন মদন মিত্র। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে লড়ার আগে শুভেন্দুর বিপরীতে মদনই প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। এর ইনামও পান মদন। শুভেন্দু দল ছাড়তেই তড়ঘড়ি পরিবহন দফতরে নতুন কমিটি গড়ে তাঁকে চেয়ারম্যানের পদে বসানো হয়। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে প্রথম মমতা মন্ত্রিসভায় মদনই হয়েছিলেন পরিবহন মন্ত্রী। কিন্তু সারদা কাণ্ডে নাম জড়ানোয় ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় মদনকে। সেই জায়গায় পরিবহনমন্ত্রী করা হয় শুভেন্দু অধিকারীকে।
২২ মাস জেলে ছিলেন
সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে অন্যান্য ইস্যুতে মদনের নামে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সালে কামারহাটি থেকে দাঁড়িয়ে প্রথমবার বিধায়ক হন মদন মিত্র। প্রথম বারেই শিকে ছেড়ে। পরিবহন দফতরের মন্ত্রী করা হয়। সামলেছেন ক্রীড়া দফতরও৷ এরপরই চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে মদন মিত্রের নাম জড়ায়৷ একাধিক অভিযোগ ওঠে৷ মন্ত্রীত্ব-বিধায়ক পদ ছাড়তে হয়৷ তাও রক্ষা হল না জেলযাত্রা থেকে৷ ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর সারদাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন তৎকালীন পরিবহন মন্ত্রী মদন মিত্র । ২২ মাস জেলে কাটানোর পর জামিন পান তিনি। আলিপুর আদালতে ১৫ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দেওয়া হয় তাঁকে। স্থানীয় থানায় পাসপোর্ট জমা রাখা সহ একাধিক শর্ত আরোপ করা হয় তার উপর। প্রথমে প্রভাবশালী তত্ত্বে বেশ কয়েকবার জামিন খারিজও হয় তাঁর। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। কামারহাটিতে একুশের ভোটে প্রার্থী হওয়ার পরেও ইডির দফতরে হাজির্ দিতে যেতে হয়েছে মদনকে। সারদাকাণ্ডে ২ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকার আর্থিক তছরুপের মামলার সম্প্রতি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।
মদনের ক্যারিশ্মা জানেন তৃণমূলনেত্রীও
ব্যারাকপুর, কামারহাটি সংশ্লিষ্ট এলাকায় বরাবরই মদন মিত্রের একটা ক্যারিশ্মা কাজ করে৷ তাই ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের সময় তিনি যখন জেলবন্দি তখনও তৃণমূলনেত্রী তার ওপরেই ভরসা রেখেছিলেন। সেবার নিজে হাতে নয় আইনজীবীকে দিয়ে মনোনয়ন জমা করতে হয়েছিল মদনকে। গত বিধানসভায় জেলে থেকে বাম প্রার্থী মানস মুখোপাধ্যায়ের কাছে মাত্র ৪,১৯৮ ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন মদন। বিধানসভা নির্বাচনে মদন মিত্রের হারের কারণ অনুসন্ধানে ঢের জলঘোলাও সেইসময় হয়েছিল কামারহাটিতে৷ এরপর ২০১৯-এ ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে দল প্রার্থী করে তাঁকে। সেবার বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-এর খাস তালুকে পবন সিং-এর কাছে ৩৬ হাজারেরও বেশি ভোটে হারতে হয় মদনকে। তবে এটা ঠিক, জননেতা হিসেবে বরাবরই একটা আলাদা ইমেজ রয়েছে মদনের৷ রাতবিরেতে ফোন থেকে শুরু করে যেকোনও সমস্যায় হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সুনাম রয়েছে তাঁর৷ তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর যদি কাউকে এককথায় 'মাস লিডার' বলা হয় তিনি হলেন মদন মিত্র৷
মদনের প্রতি রুষ্ট হয়েও তিনিই 'ভরসা' মমতার
২০১৭ সালে অ্যাপোলো কর্তাকে প্রকাশ্যে শাসাতে দেখা গিয়েছিল মদন মিত্রকে। শোনা যায় সেই সময় বিষয়টা একেবারের ভাল ভাবে নেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বার্তা মদনের কাছে পৌঁছেও দেওয়া হয়েছিল। একসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন মদন। কিন্তু, সারদাকাণ্ডে গ্রেফতারি, বিধানসভা ভোটে হার, এসবের পর কিছুটা পিছনের সারিতে চলে গিয়েছেন মদন মিত্র। একপর সক্রিয় রাজনীতি থেকে খানিকটা উধাওই ছিলেন তিনি। এই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটি পেজ খুলেছিলেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন 'citizen madan mitra'। সেখান থেকেই বিভিন্ন পোস্ট করতেন নিয়মিত। বিগত কয়েক বছর ধরে মদন মিত্র লাইভে থাকা মানেই তুফান। যা নিয়ে জোর আলোচনা চলত সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁকে নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে কম খিল্লিও হয়নি। তবে তিনি মদন মিত্র। রাজ্য রাজনীতির অন্যতম রঙিন চরিত্র বলা মনে করা হয় তাঁকে। তাই ভোট যত এগিয়েছে ততই মদনে আস্থা বেড়েছে নেত্রীর৷ শোভন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়রা যেভাবে একের পর এক দল ত্যাগ করেছেন তখন মদন মিত্রের মতো পুরানো দিনের সৈনিক কিন্তু নেত্রীর পাশেই ছিলেন৷ কখনওই দলনেত্রী-তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে বেসুরো কথা বলেননি। বরং নেত্রীকে নিয়ে গান বেঁধেছেন৷ সরাসরি অমিত শাহ এবং মোদীকে আক্রমণ করেছেন৷ স্বাভাবিকভাবেই গানের মোড়কে রাজনীতির লড়াইকে জনপ্রিয় করেছেন৷ এবার সেই আনুগত্যের পুরস্কার পেয়েছেন মদন মিত্র৷ একুশের ভোটে কামারহাটি থেকে তাঁকেই প্রার্থী করেছেন মমতা।
প্রচারের আলোর বাইরে থেকে ফের 'কামব্যাক'
একাধিক আইনি জটিলতার কারণেই সম্ভবত তাঁকে থাকতে হয়েছিল পিছনের সারিতে৷ দলও তাঁর উপর সেই সময় আস্থা রাখেনি। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের বহু যুদ্ধের নায়ক মদন মিত্র জেলযাত্রার আগে যেখানে শেষ করেছিলেন এবার সেখান থেকেই শুরু করলেন৷ এই নিয়ে পরপর তিনবার কামারহাটি থেকে প্রার্থী হয়েছেন মদন মিত্র৷ মদন মিত্রের 'ফেমাস' ইমেজকেই বিধানসভা নির্বাচনে কাজে লাগাতে চাইছে তৃণমূল। প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই জোরকদমে প্রচারের ময়দানে নেমে পড়েছেন তিনি। নিজের পছন্দে চলাফেরার অভ্যস্ত মদন, তাই কখনও তিনি মাথায় লাল পাগড়ি, গলায় রজনীগন্ধার মালা পরে হুড খোলা জিপে নির্বাচনী প্রচারে নামছেন। কখনও আবার বিরোধী ও দলবদলুদের বিঁধতে গান গাইছেন। রাজনীতিতে এক রঙিন চরিত্র মদনের সেইসব কীর্তিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমেই বাড়ছে তাঁর ফ্যান ফলোয়ার। কিন্তু তাতে আদৌ লাভ হবে তো মাটি কামড়ে পড়ে থাকা রাজনীতির ‘লাভলি বয়’ মদন মিত্রের। কারণ এবার লড়াইটা কিন্তু বেশ কঠিন। কারণ বিজেপি কামারহাটি কেন্দ্রে রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করেছে। মদন মিত্রের বিপরীতে রাজুকে প্রার্থী করে তৃণমূলকে কড়া টক্কর দিয়েছে বিজেপি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন কামারহাটির বিজেপি কর্মীর সমর্থকরা। অন্যদিকে বামেদের তরুণ নেতা সায়নদীপ মিত্রকে কামারহাটিতে পাঠিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। ১৯৬৭ থেকে টানা ২০০৬ অবধি কামারহাটি বিধানসভা কেন্দ্রে জিতেছে সিপিএম। ব্যতিক্রম ছিল ১৯৭২ সাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমনে ২০১১ সালে পরিবর্তনের ঢেউয়ে মদন মিত্র জিতে আসেন এই কেন্দ্র থেকে। কিন্তু ফের ২০১৬ সালের বিধানসভায় মদন হেরেছেন সিপিএম প্রার্থী মানস মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তাই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কামারহাটিতে লড়াই এবার ত্রিমুখী।
২০১৯ সালে দমদম লোকসভা আসনের অন্তর্গত কামারহাটিতে বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য পেয়েছিলেন, ৪৫,৬৩১ ভোট। সেখানে সিপিএম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য পেয়েছিলেন ২১,৭৭০ ভোট। আর তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় পেয়েছিলেন, ৬৩,৩৫৬ ভোট। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এবার তৃণমূলের কাছে কামারহাটি সুবিধাজনক জায়গায় আছে। কিন্তু একুশের বিধানসভা ভোটের আগে কামারহাটি এলাকায় বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে অনেকটাই। তাই লড়াইটা যে এবার আরও কঠিন তা ভাল করেই জানেন মদন।