বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা বলছে বাংলায় এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে দুই শিবিরের। এই দুই শিবির মানে অবশ্যই ক্ষমতাসীন তৃণমূল ও উনিশের লোকসভা ভোটে এরাজ্যে ভাল ফল করে তাক লাগিয়ে দেওয়া বিজেপি। লোকসভা ভোটে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে দিল্লির মসনদে বসার পর থেকেই মোদী-শাহ জুটি বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখে চলেছেন। আর তাই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার ভোট প্রচারে চলে আসছেন রাজ্যে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের হাবভাবে মনে এবারের বঙ্গভোটে তাঁদের কাছে জীবন-মরণের লড়াই যেন। এই আবহে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতুয়াদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ওড়াকান্দি সফর তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। মতুয়া ভোট নিজেদের দিকে রাখতে মোদী মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন বলে অনেক বিশষেজ্ঞরই দাবি। এই আবহে মোদীর ওড়াকান্দি সফরের সুফল গেরুয়া শিবির বঙ্গভোটে পায় কিনা চলুন সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
মতুয়া ভোট একুশের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর
পশ্চিমবঙ্গে ৮ দফা নির্বাচনে মতুয়া ভোট এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের ৮৪টিতে মতুয়া ভোটারের সংখ্যা ১৭ লক্ষের বেশি। এরমধ্যে ৩৭ থেকে ৪০টি আসনে মতুয়াদের দাপট প্রবল। বাকি ৪০-৫০টি আসনেও রয়েছেন মতুয়া সম্প্রদায়ের বহু মানুষ। বাম আমলে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট সেভাবে আলাদা করে চিহ্নিত হতো না। তবে কালক্রমে মতুয়াদের মধ্যে তৃণমূলের প্রভাব বাড়তে দেখে বাম জমানার শেষ দিকে ঠাকুরবাড়িতে প্রভাব বিস্তারের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল বাম শিবির। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট থেকেই ঠাকুরবাড়িতে তৃণমূলের প্রভাব অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে সেবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ঘাঁটি বলে পরিচিত দুই ২৪ পরগনা এবং নদিয়ায় অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলও বলছে, ওই তিন জেলায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল তৃণমূলের। বামেদের প্রভাব কার্যত ছিলই না । ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও মমতার দিকেই ছিল মতুয়াদের সমর্থন। তবে গত লোকসভা নির্বাচনে মতুয়ারা বিজেপি-কে দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে মতুয়াপ্রধান দুই লোকসভা কেন্দ্র বনগাঁ ও রানাঘাটে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিল বিজেপি। বনগাঁয় ঠাকুরবাড়ির ছেলে শান্তুনু ঠাকুর জেতেন ১ লাখের বেশি ভোটে। রানাঘাটে জগন্নাথ সরকার জয় পান ২ লাখেরও বেশি ব্যবধানে। এখন সেই ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখাই বিজেপির কাছে মূল চ্যালেঞ্জ।
ওড়াকান্দি সফর কি মোদীর মাস্টারস্ট্রোক?
করোনা মহামারি কালে প্রথম বিদেশ সফর করলেন প্রধানমন্ত্রীর। আর প্রথম সফরেই গেলেন বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশের ৫০তম স্বাধীনতা দিবস স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনই মোদীর দু’দিনের বাংলাদেশ সফরের মূল লক্ষ্য ছিল। সেখানে বঙ্গ ভোটের আবহে যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে গিয়ে মোদীর পুজো দেওয়া ও ওড়াকান্দিতে মতুয়া ধাম দর্শন সকলেরই নজর কেড়েছে। বাংলায় মতুয়া ভোট নিজেদের পক্ষে টানতেই মোদীর এই মতুয়া-প্রীতি বলে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। তাঁর এই ওড়াকান্দি সফর নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে দেশে তা ভালোই জানেন প্রধানমন্ত্রী। তাই মোদীও ওড়াকান্দিতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ২০১৫ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের সময়ই তাঁর ওড়াকান্দি আসার ইচ্ছে ছিল। তাঁর সেই প্রত্যাশা, কামনা পূর্ণ হল। গত শনিবার মোদীর ওড়াকান্দি সফরের সঙ্গী হয়েছিলেন বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরও৷ মতুয়া মতবাদের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে ঠাকুরবাড়ির সন্তান শান্তনুর প্রসংসাও শোনা যায় মোদীর গলায়। উল্লেখ করেছেন বড়মার স্নেহ-ভালবাসার কথাও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওড়াকান্দিতে গিয়ে যা বলেছেন তাতে পুরোপুরি রাজনৈতিক বার্তাই খুঁজে পাচ্ছেন ওয়াকিবহাল মহল।
মতুয়া প্রীতি বিজেপির ভোট রাজনীতি বলছে বিরোধীরা
অনেকদিন থেকেই ওড়াকান্দির মতুয়া ঠাকুরবাড়িতেআসার ইচ্ছা ছিল। মোদী বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে যখন একথা বলছনে ঘটনাচক্রে সেদিনই বাংলায় আটদফা ভোটের প্রথম দফা শুরু হয়। হিসেব কষেশ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ওড়াকান্দি সফর করেছেন বলে দাবি করছে বিরোধীরা। বাংলায় মতুয়া ভোট নিজেদের পক্ষে টানতেই মোদীর এই মতুয়া-প্রীতি এমন কটাক্ষ কটাক্ষও ভেসে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে ‘কূটনৈতিক’সফরে গিয়ে মোদীরওড়াকান্দিতে যাওয়ায় অনেকেই রাজনৈতিক ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। এই নিয়ে সবথেকে বেশি সরব হয়েছেন বাংলায় বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলনেত্রী অভিযোগ করেছেন, রাজ্যে ভোট চলছে, আর নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে গিয়ে বাংলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন৷ এহেন কাজে তিনি নির্বাচনী বিধিভঙ্গ করছেন৷ মমতা অভিযোগ করেন , গত লোকসভা ভোটের সময় বাংলাদেশের অভিনেতা ফেরদৌস জোড়াফুলের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। আর তার জেরেই বাংলাদেশ সরকারকে বলে ফিরদৌসের ভিসা বাতিল করিয়েছিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলনেত্রী। বাংলাদেশে মতুয়া তীর্থে মোদীর সফরকে কটাক্ষ করে মমতা বলেছেন, 'বাংলায় নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভোট পেতে ও প্রভাবিত করতেই এই প্রচেষ্টা।' যদিও তৃণমূলনেত্রী মতুয়া সম্প্রদায়ের নাম সরাসরি নেননি।
বাংলার মসনদ দখল মতুয়া ভোট কতটা জরুরী বিজেপির?
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে বিজেপি বরাবরই মতুয়া ভোটকে কাজে লাগিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের একাংশের। তাঁদের অভিযোগ, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলায় প্রচারে এসে মতুয়া আবেগকে কাজে লাগিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। দিল্লিতে বিজেপি-র সরকার প্রতিষ্ঠা হলে, মতুয়াদের ভারতের নাগরিকত্ব পেতে আর অসুবিধা থাকবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ঠাকুরনগরে বড়মা-র সঙ্গে মোদীর সাক্ষাৎ নিয়েও এমনই তত্ত্ব উঠে এসেছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার মোদী সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পরও, মতুয়াদের নাগরিকত্বের বিষয়টি এখনও অথৈ জলে। সেই নিয়ে বারবার বেসুরো হতে দেখা গেছে শান্তনু ঠারুরকে। বিজেপি নেতৃত্বের তাঁর মন কষাকষির কথাও সামনে এসেছে। মতুয়া ভোট নিজেদের দিকে রাখতে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলায় এসে শাহ নিজেই জানিয়েছিলেন, কোভিড টিকাকরণের পর্ব শেষ হলেই, মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ শুরু হবে। বলাই বাহুল্য ২০১৯ সালের লোকসভার পর বাংলার ক্ষমতা দখলের লড়াইতে এবার বিজেপির হাতিয়ার নাগরিকত্ব ইস্যু। সম্প্রতি শাহের হাতে প্রকাশিত বিজেপির ইস্তেহারে বলা হয়েছে, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই শরণার্থীদের নাগরতিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রাজনৈতিক মহলের মতে, রাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটকে ধরে রাখতেই ইস্তেহারে নাগরিকত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মতুয়া ভোটের দিকে চেয়েই শান্তনু ঠাকুরের দাদা সুব্রত ঠাকুররে গাইঘাটা থেকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। সুব্রতকে প্রার্থী করে নাগরিকত্ব না পাওয়া মতুয়াদের তাঁদের দিকে ফেরানোই চ্যালেঞ্জ গেরুয়া শিবিরের। তার মাঝেই বাংলায় ভোটগ্রহণ চলাকালীন সুকৌশলে ঠাকুর পরিবারের সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে ওড়াকান্দি গিয়ে মোদী আসলে বিজেপি-র পক্ষে ভোট টানার চেষ্টা করেছেন বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
পাটিগণিতের হিসেব কী বলছে
অমিত শাহ রাজ্যে ২০০ আসন পাওয়ার লক্ষ্য বেঁধে দিলেও বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ১৫০ থেকে ১৬০টি আসনে জয় পেতে পারে পদ্মশিবির। এ-ও জানা গিয়েছে যে, ওই সমীক্ষার ক্ষেত্রে বিজেপি অনেকটাই নির্ভর করেছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের উপর। সেই নির্বাচনে মতুয়ারা বিজেপি-কে দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন। রাজ্যের ৩০টি আসনে মতুয়া ভোটারদের প্রাধান্য। তারাই সরাসরি জয় পরাজয় নির্ধারণ করে। আর বাকি ৪৫ থেকে ৫০টি আসনে মতুয়া-ভোট কিঞ্চিৎ ফ্যাক্টর। একে তো মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বড় ছেলে সুব্রত ঠাকুরকে প্রার্থী করে বিজেপি মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছে। তৃণমূল এবার ঠাকুরবাড়ির কাউকে প্রার্থী করেনি। এমনকি মতুয়া সম্প্রদায়ের কাউকেই প্রার্থী করা হয়নি। তা নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে মতুয়াদের মধ্যে । টিকিট পান নি মমতাবালা ঠাকুরও। তৃণমূলপন্থী মতুয়াদের মধ্যেকার সেই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে সুব্রত ঠাকুরকে প্রার্থী করা বিজেপির কৌশলী চাল। এতে বনগাঁ ও রানাঘাট লোকসভা এলাকার ১৪টি কেন্দ্রে বিজেপির এই কৌশলী সিদ্ধান্ত একটা বড় ফ্যাক্টর হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বনগাঁ ও রানাঘাটের ১৪টি বিধানসভা কেন্দ্র ছাড়াও উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর, হাবড়া, সন্দেশখালি, পূর্ব বর্ধমানের জামানপুর, কালনা, রায়না-সহ মোট ৩০টি আসনে মতুয়ারা নির্ণায়ক শক্তি। উত্তরবঙ্গের মালদহ ও জলপাইগুড়িতেও মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। মতুয়াদের একাংশের দাবি, রাজ্যের ৮৯টি থেকে বেড়ে এখন ১০২টি বিধানসভা কেন্দ্র এলাকায় মতুয়ারা থাকেন। ঘাসফুলের সঙ্গে থাকা মতুয়া ভোট গত লোকসভা নির্বাচনে পদ্মফুলের দিকে এসেছিল মূলত নাগরিকত্ব ইস্যুতে বিজেপি-র প্রতিশ্রুতিকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকারের দেড় বছর কেটে গেলেও দেশে এখনও সিএএ কার্যকর হয়নি। এই অবস্থায় ওড়াকান্দিতে মোদী ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশে মতুয়াদের তীর্থক্ষেত্রে স্কুল তৈরি করবে ভারত সরকার। সেইসঙ্গে ওড়াকান্দিতে যে ভারতীয় তীর্থযাত্রীরা আসেন, তাঁদের আরও সাহায্য করবে কেন্দ্র। বাংলাদেশ সফরে গিয়ে বারবার বাংলায় ট্যুইট করতেও দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীকে। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় তিন কোটির বসবাস পশ্চিমবঙ্গে। মোদীর বাংলাদেশ সফর ভোটবঙ্গে বিজেপির জন্য ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হয় কিনা তার জবাব অবশ্য দোসরা মেয়ের আগে মিলবে না।