পঞ্চম দফাতেও ভোট-হিংসার সাক্ষী থাকল রাজ্য। বোমাবাজি, গুলি, মারামারি, বুথ দখলের চেষ্টার অভিযোগ, কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি ভাঙচুর, এমনকী প্রার্থীকেও আক্রান্ত হতে হল এই দফায়। সবথেকে বেশি হিংসার সাক্ষী থাকে নদিয়া জেলা। সেই জেলার শান্তিপুর বিধানসভা কেন্দ্রে দফায় দফায় অশান্তি ছড়ায়। এছাড়া পূর্ব বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেও সকাল থেকে বিক্ষিপ্ত অশান্তির খবর পাওয়া যায়। তবে উত্তরবঙ্গে শান্তিতেই ভোটপর্ব সম্পন্ন হয়। একনজরে দেখে নেব পঞ্চম দফার ভোটের চালচিত্র-
নদিয়া
বুথ দখলের চেষ্টা, বোমাবাজি-গুলিবিদ্ধ যুবক
ভোট শুরু হওয়ার পর থেকে খবরের শিরোনামে ছিল নদিয়ার শান্তিপুর। সবথেকে বেশি অশান্তি ছড়ায় শান্তিপুরে। বিজেপি ও তৃণমূলের সংঘর্ষে অশান্ত হয়ে ওঠে ওই বিধানসভা এলাকা। শান্তিপুরের একাধিক বুথে BJP কর্মীদের ভোটদানে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বেলেডাঙায় বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকারকে ঘিরে খেলা হবে স্লোগান দেন তৃণমূল কর্মীরা। বিক্ষোভের মুখে এলাকা ছাড়েন প্রার্থী। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ে সেখানে। দুপুরের দিকে রাজপুরে গুলি চলে। জখম তৃণমূল সমর্থককে শক্তিনগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
খবরের শিরোনামে ছিল চাকদাও। সেখানে বুথের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয় এক নির্দল প্রার্থীর কাছ থেকে। কৌশিক ভৌমিক নামে ওই প্রার্থীর অভিযোগ, তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বুথের কাছে পুলিশের সামনেই বন্দুক নিয়ে ঘুরছিল। পুলিশ কিছু বলেনি। তিনি প্রতিবাদ করায়, তাঁকে বন্দুক ছুড়ে মারা হয়। এরপর নির্দল প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
কল্যাণী বিধানসভার গয়েশপুরের ২৭০ নম্বর বুথে বোমাবাজি হয়। অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেস। বোমার আঘাতে জখম হন এক বিজেপি কর্মী। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পরে সেখানে আসেন সাংসদ শান্তনু ঠাকুর। তখন তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলের লোকজন। শান্তনু জানান, এটা তাঁর লোকসভা এলাকা। তাই তিনি এসেছেন। আবার এখানকার ২৬০ নম্বর বুথেক বিজেপি-র বুথ সভাপতির বাড়িতে তাণ্ডব, হামলা চালানো হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। বিজেপির অভিযোগ, এলাকার একাধিক বিজেপি কর্মীর বাড়িতে হামলা চালায় শাসকদলের লোকজন। গয়েশপুরের আরও একাধিক জায়গায় বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে হামলার অভিযোগ ওঠে।
উত্তর ২৪ পরগনা
সল্টলেকে ধুন্ধুমার, আক্রান্ত বিজেপি প্রার্থী
সাতসকালে তৃণমূল ও বিজেপির সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় সল্টলেকের শক্তিনগর এলাকা। সেখানে দুই পক্ষ একে অপরের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। হয় ইটবৃষ্টি। মহিলাকে রাস্তায় ফেলে মারধর করা হয়। ঘটনাস্থলে আসেন বিজেপি প্রার্থী সব্যসাচী দত্ত ও তৃণমূলের সুজিত বসু। দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আবার সল্টলেকের নয়াপট্টিতে বিজেপি প্রার্থীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন সব্যসাচী।
বেলার দিকে বিধাননগরের দত্তাবাদে বেআইনি জমায়েত হঠাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। বহিরাগতরা ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ ওঠে। এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়।
মধ্যমগ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের হুমকি দিতে দেখা যায় সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে। আঙুল উঁচিয়ে এক জওয়ানকে তিনি বলেন, 'শীতলকুচি বানাবেন না।'
মিনাখাঁ, বরানগর, দেগঙ্গা, পানিহাটিতেও বিক্ষিপ্ত অশান্তি ছড়ায়। তেলেনিপাড়ায় বিজেপি এজেন্টকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। বরানগরের আলমবাজারে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ হয়। এক তৃণমূল কর্মীকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী পার্নো মিত্রকে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। গো ব্যাক স্লোগানও ওঠে।
ফের গুলি চালানোর অভিযোগ ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। দেগঙ্গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নির্বাচন কমিশন।
সাতসকালে কামারহাটির ১০৭ নম্বর বুথে অসুস্থ হয়ে বিজেপি এজেন্টের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর রিপোর্ট তলব করে কমিশন। ভোটের একেবারে শেষপর্বে কামারহাটিতে আক্রান্ত হন বিজেপি প্রার্থী রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাঁর উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ। হাতে চোট পান তিনি। ভাঙচুর করা হয় তাঁর গাড়িও। অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্রও। তাঁকে অক্সিজেন মাস্ক দিতে হয়।
পূর্ব বর্ধমান
কালনায় উত্তেজনা, সিদ্দিকুল্লার হেলমেট
পূর্ব বর্ধমানের বড় নীলপুরে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ হয়। ঘটনায় জখম হন ২ পক্ষের বেশ কয়েকজন। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হেলমেট পরে ভোট দিয়ে নজর কাড়েন মন্তেশ্বরের তৃণমূল প্রার্থী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। তিনি জানান, সাবধানতা অবলম্বন করে তিনি হেলমেট পরেছেন। আবার ওই কেন্দ্রের ২৪০-২৪১ নম্বর বুথে তৃণমূলের এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
দলীয় পতাকা ছেঁড়ার অভিযোগ ঘিরে রায়নার ফকিরপুরে হাতাহাতিতে জড়ায় তৃণমূল ও বিজেপি। দক্ষিণ বর্ধমান কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তোলেন স্থানীয় মহিলারা। বিজেপি কর্মীরা ছাপ্পা ভোট দিচ্ছিল, এই অভিযোগ তাঁদের। বর্ধমান উত্তরের সরাইটিকরে বিজেপির এজেন্টকে মারধর করা হয়। মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় তাঁর। আক্রান্ত হন মোট ৪ জন।
দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কালিম্পংয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট
দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কালিম্পং জেলার বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটপর্ব সম্পন্ন হয়। দার্জিলিঙের পাতলেবাস কমিউনিটি হলে সস্ত্রীক ভোটদান করেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা-১-এর সভাপতি বিমল গুরুং। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ বিধানসভার দেমধাপাড়া একটি বুথে ভোট দেননি ভোটাররা। রেলগেটের দাবিতে তাঁরা বিক্ষোভ দেখান। মোটের উপর উত্তরবঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
ভোটদানের হার, এগিয়ে জলপাইগুড়ি
সবথেকে বেশি ভোট পড়ে জলপাইগুড়িতে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ভোটদানের হার প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, তখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৭৮.৩৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। জলপাইগুড়িতে ভোট পড়ে ৮১.৭৩ শতাংশ, কালিম্পঙে ভোট ৬৯.৫৬ শতাংশ, দার্জিলিঙে ৭৪.৩১ শতাংশ, উত্তর ২৪ পরগনায় ৭৪.৮৩ শতাংশ, পূর্ব বর্ধমানে ৮১.৭২ শতাংশ ও নদিয়ায় ভোট পড়ে ৮১.৫৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
চতুর্থ দফায় উত্তরবঙ্গের শীতলকুচিতে ব্যাপক অশান্তি হয়েছিল। পঞ্চম দফায় উত্তরবঙ্গে ভোট হিংসা হয়নি বললেই চলে। তবে দক্ষিণবঙ্গে হিংসার ছবিটা বদলাল না। সকাল থেকে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া ও বর্ধমানের একাধিক জায়গায় হিংসার ছবি সামনে আসে। দেখেশুনে অনেকেই বলছেন, আগের দফার ঘটনার পর কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আরও সতর্ক করেছিল নির্বাচন কমিশন। তারপরও হিংসার ছবিটা বদলাল না। তৃণমূলের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। অন্যদিকে বিজেপির পাল্টা দাবি, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে স্থানীয় পুলিশ সাহায্য করেনি। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে অশান্তি রুখতে পারেনি।