দিলীপ ঘোষের পর রাজ্য বিজেপির সভাপতি কে? একুশের ভোটের পর থেকেই এই জল্পনা ঘুরে বেড়াচ্ছিল মুরলীধর সেন লেনের অন্দরে। যে রহস্য়ের অবসান হয়েছে গত সোমবার। রাজ্যস্তর থেকে একেবারে কেন্দ্রীয় স্তরে উন্নীত হলেন দিলীপবাবু। বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি করা হয়েছে তাঁকে। আর দলের ব্যাটন গিয়েছে বালুরঘাটের তরুণ সাংসদ সুকান্ত মজুমদারের হাতে। এতেই অনেকে বলতে শুরু করেছেন বঙ্গ বিজেপিতে নাকি দিলীপ জমানার অবসান হয়েছে। কিন্তু সত্যি কী তাই? কারণ মুরলীধর লেনের ঘনিষ্ঠ লোকেরা বলছেন আসলে কোনও ক্ষমতারই নাকি হাতবদল হয়নি। দিলীপের ঘনিষ্ঠ লোককেই তাঁর ইচ্ছানুসারে বসান হয়েছে বঙ্গ বিজেপির সভাপতি পদে।
দিলীপ ও সুশান্ত সম্পর্কের রসায়ন
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বঙ্গ বিজেপির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের পর দ্বিতীয় দফায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের পর, মেয়াদ ফুরনোর আগেই সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দিলীপ ঘোষকে। শোনা যায় বঙ্গ ভোট মিটতেই দিলীপের উত্তরসূরী বাছার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রাজ্য সভাপতির কাছেই নাড্ডা জানতে চেয়েছিলেন, আপনার মতে কার সভাপতি হওয়া উচিত? তখন বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদারের নামটাই নাাকি নেন দিলীপ। ব্যাখ্যা দেন, অনেকেই যোগ্য। তবে সভাপতি হিসেবে সুকান্তকে মেনে নিতে দলের কেউ কুণ্ঠিত হবেন না। আর দিলীপের মত সুকান্তও আরএসএসের ঘরের ছেলে।
সুকান্তকে নিয়ে দিলীপ যা বলছেন
সোমবার সুকান্তর নাম বিজেপি রাজ্য সভাপতি হিসেবে আসতেই শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন দিলীপ। মঙ্গলবার কলকাতায় একাধিক বিজেপি নেতৃত্ব অনুপস্থিত থাকলেও দিলীপ সুকান্ত মজুমদারকে স্বাগত জানিয়েছেন আন্তরিক ভাবেই। সাহায্য করার জন্য তিনি যে সবসময় প্রস্তুত এমন বার্তাও দিচ্ছেন দিলীপ। সুকান্ত মজুমদারের বয়স কম এবং অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত মানুষ। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই দল তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি।
এবার নজরে রাজ্য কমিটি
রাজ্য কমিটিতে রদবদল নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুখ না খুলেলও দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন খুব শীঘ্রই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। অর্থাৎ নতুন সেনাপতির জন্য নতুন দল সাজাতে চলেছে বঙ্গ-বিজেপি। সূত্রের খূবর, পুজোর মুখেই বিজেপির রাজ্য কমিটিতে বড়সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে । বঙ্গ বিজেপিতে দিলীপ ঘনিষ্ট বলে পরিচিত সায়ন্তন বসু, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়, শমিক ভট্টাচার্য, প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোর্তিময় সিং মাহাতরা এতদিন রাজ্য বিজেপিতে সাধারণ সম্পাদক, দলের মুখ্যপাত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। সূত্রের খবর এই রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদগুলিতে এবার নতুন মুখ আসতে পারে। পাশাপাশি যুব সংগঠনেও বড়সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে৷ রাজ্য কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার দৌঁড়ে রয়েছেন- ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং, বঙ্গ বিজেপির যুব মোর্চার দায়িত্ব সামলানো দেবজিৎ সরকার এবং কেন্দ্রীয় বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্কের অন্যতম ডঃ অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।
২০২৪-এর লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে গেরুয়া শিবির
একুশে ক্ষমতায় আসা হয়নি। তারপর থেকেই দলে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে রাজ্য নিয়ে এখনি আশা ছাড়তে নারাজ অমিত শাহরা। তাই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে বঙ্গে ধীরে ধীরে এগোতে চাইছে গেরুয়া শিবির। আর এক্ষেত্রে রাজ্য ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনাগুলিকেই হাতিয়ার করতে চাইছে বিজেপি। হাইকোর্টে চলা এই মামলা ও সিবিআই চার্জশিট নিয়ে ইতিমধ্যে অস্বস্তিতে রয়েছে তৃণমূল। তারমধ্যে মগরাহাট পশ্চিমের বিজেপি প্রার্থী মানস রায়ের মৃত্যু বিজেপির হাতে নতুন হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনের গণনার দিনই আক্রান্ত হন মানস সাহা ওরফে ধূর্জটি। গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসতেই তার উপরে হামলা চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। ওই হামলায় মাথায় গুরুতর চোট পান মানস সাহা। তার পর থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। বুধবার ঠাকুরপুকুরের এক নার্সিং হোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এদিকে নারদ কাণ্ড, কয়লা কাণ্ড, আইকোর মামলায় যেভাবে সক্রিয় হয়ে রয়েছে সিবিআই ও ইডি এবং রাজ্যের একের পর এক হাইপ্রফাইল নেতা-মন্ত্রীকে তলব করা হচ্ছে তাও যেথষ্ট ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে সামনে রেখেই এখন এগোতে চাইছে গেরুয়া শিবির। তাই সুকান্ত মজুমদার দায়িত্ব পেয়েই সংগঠন পোক্ত করতে ঘুটি সাজাতে শুরু করেছেন। ২০২৪ লোকসভা ভোটকে সামনে রেখেই যে যাবতীয় কাজ করা হবে, তাতে লুকোছাপা রাখেননি তিনি। এমনকী বেঁধে দিয়েছেন আগামী লোকসভায় বাংলা থেকে আসন জয়ের টার্গেটও। দলের হারের জন্য অনেকেই প্রাক্তন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষকে দায়ী করেন। অনেক সময়ই দিলীপের বেঁফাস মন্তব্য দলকে বেকায়দায় ফেলেছে। তাই তাঁর সরে যাওয়াটা হয়তো সময়ের অপেক্ষা ছিল। কিন্তু রাজ্য বিজেপিতে পদ হারালেও তাঁর প্রভাব যে একেবারেই থাকবে না, এমনটা ভাবাও হয়তো ঠিক নয়। কারণ একবগ্গা দিলীপই এখনও পর্যন্ত রাজ্য বিজেপির সবচেয়ে সফল সভাপতি। তাই ২০২৪-এর লক্ষ্যে নাড্ডা-মোদীদের গেমপ্ল্যান অনুযায়ী হয়তো উত্তরসূরীকে জায়গা ছেড়ে দিলেন খড়গপুরের সাংসদ। ঠোঁটকাটা দিলীপের বদলে এবার ভদ্র, শিক্ষিত, রুচিশীল সুকান্ত সভাপতির আসনে বসলেও ভেতরে হয়তো ক্ষমতার হাতবদল হয়নি, বরং দিলীপ বিরোধী গোষ্ঠীকেই শান্ত করার পথ খুঁজেছেন নাড্ডারা, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।