
শহর কলকাতায় ২০১৫ সালে শেষবার পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর পুরবোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নানা কারণে এতদিন পুরভোট করা যায়নি। অবশেষে শিলমোহর মিলেছে। আদালত বাধা না দিলে আগামী ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা ও গঙ্গাপারের আরেক শহর হাওড়ায় হতে চলেছে পৌর নির্বাচন। ফলত সাজো সাজো রব শুরু হয়ে গিয়েছে। এদিকে একুশের বিধানসভা ভোট ও তারপর উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয়জয়কার অব্যাহত। এই আবহে পুরভোটেও যে তাদের বিজয়রথ চলতে থাকবে সেই বিষয়ে যথেষ্ট আশাবাদী ঘাসফুল শিবির। আর তা হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনের ইতিহাস বলছে, গত পাঁচটি ভোটের মধ্যে তিনটিতেও বাজিমাত করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। আর সবচেয়ে ভাল ফল হয়েছিল ২০১৫ সালের কলকাতার পুরভোটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বাংলায় ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বড় লালবাড়ি দখলে আসার ১১ বছর আগেই ছোটলালবাড়িতে আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক গত ৫টি নির্বাচনে কেমন ফল করেছিল ডান-বাম দুই শিবির।
২০১৫ সালের পুরভোট
এখনও পর্যন্ত এটাই তিলোত্তমায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পুরভোট। ২০১৬ সালে ছিল বিধানসভা নির্বাচন। ফলত সেবার পুরভোট ছিল সব দলের কাছে অ্যাসিড টেস্ট। তখন থেকেই ধীরে ধীরে বিজেপি নিজের শক্তি জানান দিতে শুরু করেছিল। যদিও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদী ঝড়ের মধ্যেও এরাজ্যে ছিল ঘাসফুলের দখলেই। সেবার বিগত পুরভোটগুলির তুলনায় দারুণ ফল করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। ১৪৪টি ওয়ার্ডের কলকাতা পুরসভার ১১৪টিতে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। সেবার মেয়র হিসাবে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ওপরই ভরসা রেখেছিলেন মমতা। যদিও পরবর্তী কালে ২০১৮ সালে মেয়র পদে পদত্যাগ করেন শোভন। তার জায়গায় মেয়র হন ফিরহাদ হাকিম।
একনজরে ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান-
মোট আসন: ১৪৪
তৃণমূলের দখলে: ১১৪
বামফ্রন্টের দখলে: ১৫
বিজেপির দখলে: ৭
কংগ্রেসের দখলে: ৫
অন্যান্য : ৩
২০১০ সালের কলকাতা পুরসভা নির্বাচন
এর ঠিক একবছর পরেই ছিল বিধানসভা নির্বাচন। যেখানে ঐতিহাসিক পালাবদল দেখেছিল বাংলা। তার একবছর আগেই অবশ্য বদলের আভাস মিলেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে কলকাতার পুরভোটে জিতে ঐতিহাসিক সাফল্য পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার পুরসভার ৯৫টি ওয়ার্ডে উড়েছিল তৃণমূলের পতাকা। প্রথমবার মেয়রের আসনে বসেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।
একনজরে ২০১০ সালের পরিসংখ্যান-
মোট আসন: ১৪৪
তৃণমূলের দখলে: ৯৫
বামফ্রন্টের দখলে: ৩২
বিজেপির দখলে: ৩
কংগ্রেসের দখলে: ১০
নির্দল : ১
২০০৫ সালের কলকাতা পুরনির্বাচন
২০০৪ সালটা তৃণমূলনেত্রীর জন্য ভাল যায়নি। লোকসভা ভোটে সারা রাজ্য থেকে মাত্র ১টি আসন জেতে তৃণমূল। ভবানীপুর থেকে নিজে জিতে কোনওরকমে সংসদে তৃণমূলের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর একবছরের মধ্যে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বামেদের দখলে যায় সেবারের পুরবোর্ড। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হবে, সেবার ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে নিজের দল গঠন করেছিলেন সদ্য প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পরবর্তীতে সুব্রতবাবুর ঘরওয়াপসি হলেও সেবার পুরভোটে তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গ করেছিলেন তিনি। ছোট লালবাড়ি হাতছাড়া হয়েছিল জোড়াফুল শিবিরের। সেবার আবার বিজেপির সঙ্গে জোট করে ভোট ময়দানে নেমেছিলেন মমতা। কলকাতা পুরসভার নতুন মেয়র হয়েছিলেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। সেবার ওয়ার্ড সংখ্যা ছিল ১৪১। এনজরে দেখে নেওয়া যাক পরিসংখ্যান।
একনজরে ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান-
মোট আসন: ১৪১
তৃণমূল ও বিজেপি জোটের দখলে: ৪৫
বামফ্রন্টের দখলে: ৭৫
কংগ্রেস ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দলের জোট: ১৯
নির্দল : ৫
২০০০ সালের কলকাতা পুরসভা নির্বাচন
২০০০ সালের পুরভোট কোনও দিনই ভুলতে পারবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সেটাই ছিল মমতা নেত্রীর প্রথম সাফল্য। সেই ভোটে বিজেপি-র সঙ্গে জোট করে লড়েছিল তৃণমূল। বাম জোটের থেকে একটা ওয়ার্ডে বেশি জয় পেয়েছিল তৃণমূল-বিজেপি জোট। ত্রিশঙ্কু ফল হলেও কংগ্রেস ও নির্দল কাউন্সিলের সমর্থন-দলবদলের ফলে প্রথমবার ভোটে লড়েই পুরবোর্ড গড়ে তৃণমূল। মেয়র হন প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
একনজরে ২০০০ সালের পরিসংখ্যান-
মোট আসন: ১৪১
তৃণমূল ও বিজেপি জোটের দখলে: ৬১
বামফ্রন্টের দখলে: ৬০
কংগ্রেস ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দলের জোট: ১৫
নির্দল : ৫
১৯৯৫ সালের কলকাতা পুরভোট
তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। কংগ্রেস শিবিরে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম জমানায় সেবার প্রথম কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে ভাল ফল করে কংগ্রেস। সোমেন মিত্রর নেতৃত্বে লড়ে সেই ভোটে কংগ্রেস একেবারে পুরবোর্ড গঠনের কাছে চলে গিয়েছিল। তবে বাম শিবির ৫টি ওয়ার্ড বেশি জিতে বোর্ড নিজেদের দখলেই রাখে। তবে বোর্ড গঠন না করলেও সেই প্রথম বাম জমানায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে লাল শিবির। বেহালার মত বাম দুর্গেও হাতের ছাপ পড়ে। ১৯৯০-এর কলকাতা পুরভোটে কংগ্রেস জিতেছিল মাত্র ৩৬টি ওয়ার্ডে, সেখান থেকে তারা পাঁচ বছর পর ৬৬টি ওযার্ডে জেতে। বামেদের আসন ৯০ থেকে কমে হয়ে ৭০। মেয়র হন প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়।
একনজরে ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান-
মোট আসন: ১৪১
বামফ্রন্টের দখলে: ৭০
কংগ্রেসের দখলে: ৬৬
বিজেপি জোটের দখলে: ২
নির্দল : ৩
সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২০টি-রও বেশি ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে তৃণমবল কংগ্রেস। শহরের সব কটা বিধানসভা ও লোকসভা আসনেই শেষ তিনটি নির্বাচনে অনায়াসে জিতেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। তাই আসন্ন কলকাতা পুরভোটে ছোট লালবাড়ি যে জোড়াফুল শিবিরের হাতেই থাকবে, তা প্রায় নিশ্চিত। এখানে মূলত লড়াইটা প্রধান বিরোধী দল কে হবে তা নিয়ে। এমনিতে বিধানসভা নির্বাচনে কলকাতায় বিজেপিই ছিল তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ। বামেরা শহরের সব বিধানসভা আসনেই তৃতীয় স্থানে শেষ করে।