প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর রবিবার ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে ভারত। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারও ২০২০ সালের মত স্বাধীনতা দিবসের পালন কিছুটা আলাদা হতে চলেছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে যতই জমায়েত এড়াতে হোক বা নির্দেশিকা মেনে চলতে হোক। এই দিনটি প্রতিটি ভারতীয়র কাছে বিশেষ। ইতিমধ্যে দোকানে দোকানে বিক্রি হতে শুরু করে দিয়েছে তেরঙা পতাকা, টুপি, পোশাক।
একইসঙ্গে স্বাধীন হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ অগাস্ট হলেও ভারতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় ১৫ অগাস্ট। অথচ স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী একই দিনই হওয়াক কথা ছিল। কিন্তু কেন ১৫ অগাস্ট দিনটিকেই বেছে নেওয়া হল স্বাধীনতা দিবস হিসাবে? আরও একবার ফিরে যাওয়া যাক সেই ইতিহাসে।
‘পূর্ণ স্বরাজে’র দাবি ও ২৬ জানুয়ারি
সালটা ছিল ১৯২৯। সেই সময় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন জওহরলাল নেহরু। সেই সময় তিনি ‘পূর্ণ স্বরাজে’র ডাক দেন। তখন ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে। বর্তমানে যা ভারতে সাধারনতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৫০ সালের ওই দিনে স্বাধীন ভারতের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয়।
তাহলে ১৫ আগস্ট কীভাবে এলো?
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু, গোটা দেশে যেভাবে বিক্ষোভের পরিমাণ বাড়ছিল, তাতে মাউন্টব্যাটেন আন্দাজ করতে পারছিলেন ১৯৪৮ পর্যন্ত আর অপেক্ষা করা যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব, ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশরা যদি ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনের অপেক্ষা করত, তাহলে হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশের হাতে কোনও ক্ষমতাই অবশিষ্ট থাকত না। ভাবগতিক বুঝে মাউন্টব্যাটনে স্বাধীনতা এগিয়ে আনেন ১৯৪৭ সালের অগাস্টে।
ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন দাবি করেছিলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনটি এগিয়ে আনার মধ্যে দিয়ে তিনি দাঙ্গা ও রক্তপাত এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। তাঁর দাবি ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর আত্মপক্ষ সমর্থনে মাউন্টব্যাটেন লিখেছিলেন, “যেখানেই সাম্রাজ্যের শাসনের অন্ত হয়েছে, সেখানেই রক্তপাত হয়েছে। এ দাম দিতেই হবে।”
ল্যারি কলিন্স ও ডমিনিক লা পিয়েরের লেখা ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইটে’ বলা হয়েছে, মাউন্টব্যাটেন নিজেই স্বাধীনতার তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই তারিখ ঘোষণা করা হবে। তাহলে ১৫ আগস্ট কেন বেছে নিয়েছিলেন তিনি? জবাবে বলেছিলেন, ১৫ আগস্ট বেছে নেয়ার কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেদিন জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাপানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এবং মাউন্টব্যাটেন সে সময় মিত্রবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতা
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির জাপান আত্মসমর্পণ করে। ওই বছর জাপানের সম্রাট হিরোহিতো রেডিওতে দেওয়া এক বক্তৃতার মাধ্যমে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানান। মাউন্টব্যাটেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে বসে শুনেছিলেন ওই ঘোষণা। দিনটির কথা বেশ মনে আছে মাউন্টব্যাটেনের। সেদিন ছিল ১৫ আগস্ট! মাউন্টব্যাটেন ছিলেন তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান সেনাপতি। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে মাউন্টব্যাটেন ১৫ অগাস্ট তারিখটিকে শুভ বলে বিবেচনা করেছিলেন, এই জন্যেই তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য ওই তারিখটি বেছে নিয়েছিলে
১৯৪৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাপানের সম্রাট হিরোহিতো একটি রেকর্ডের রেডিও ভাষণ দেন যা পরে জুয়েল ভয়েস ব্রডকাস্ট নামে পরিচিত হয়। সেই রেডিও ভাষণে তিনি মিত্রশক্তির কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করেন। মাউন্টব্যাটেন স্মরণ করতে পেরেছিলেন যে তিনি সে ভাষণ শুনেছিলেন চার্চিলের ঘরে বসে এবং মিত্রশক্তির সুপ্রিম কম্যান্ডার হিসেবে জাপানের আত্মসমর্পণের নথিতে ১৯৪৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরও করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্সে ভারতীয় স্বাধীনতা বিল পেশ করা হয়। এই বিলে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব ছিল। বিলটি ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই গৃহীত হয় এবং ১৪ অগাস্ট দেশ ভাগের পর ১৪-১৫ অগাস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে অংশ নেননি। কেননা ভারত যখন স্বাধীনতা পায়, তখন মহাত্মা গান্ধী বাংলার নোয়াখালিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে উপবাস করছিলেন।
ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস আলাদা হল কী করে?
আইন অনুযায়ী ভারতে ব্রিটিশ রাজ শেষ হয় একদিনেই, তা ১৫ অগাস্ট। কিন্তু পাকিস্তান ১৪ অগাস্ট স্বাধীন হল কীভাবে? সত্যি কথা বলতে কি, হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা বিলে দুই দেশকেই ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা ছিল। পাকিস্তান প্রথমে ১৫ অগাসটকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে মেনেছিল। পাকিস্তানের প্রথম ভাষণে জিন্না বলেছিলেন, “১৫ অগাস্ট স্বাধীন, সার্বভৌম পাকিস্তানের জন্মদিন”।
তবে ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান ১৪ আগস্টকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাতটি ছিল রমজান মাসের ২৭ তারিখ। সালটি ছিল ১৩৬৬ হিজরি। ২৭ রমজানের রাতটিকে মুসলমানরা পবিত্র রজনী হিসেবে বিবেচনা করেন।
লালকেল্লাতেই পতাকা উত্তোলন
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট জওহরলাল নেহেরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণের পর দিল্লির লাল কেল্লার লাহোরি গেটের উপর ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তারপর থেকে প্রতি বছরই স্বাধীনতা দিবসের সকালে লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐতিহাসিক মুহূর্তে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।