পঞ্চকবির অন্যতম অতুলপ্রসাদ সেন (Atul Prasad Sen)। একাধারে নামজাদা আইনজীবী। অন্যদিকে সঙ্গীতস্রষ্টা। লিখেছেন অনেক কবিতা, বেঁধেছেন বহু গান। বিলেতে ব্যারিস্টারি পাশ করার পর দেশে ফিরলেও প্রথমে সেভাবে আইনজীবী হিসেবে পসার জমাতে পারেননি। এক বন্ধুর পরামর্শে চলে যান লখনউতে। তারপর থেকে মোটামুটি সেখানেই বাস। লখনউ আপন করে নিয়েছিল অতুলপ্রসাদকে। জীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময়টা সেখানেই কাটিয়েছেন তিনি।
বাংলায় গজল রচনা
আদ্যান্ত একজন গানপাগল মানুষ ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। ওকালতির কাজের পর বাকি সমস্ত সময়টাই ব্যয় করতেন সঙ্গীতের সেবায়। গোটা জীবনে রচনা করেছেন বহু দেশাত্মবোধক, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান। তাঁর সৃষ্ট গানে হিন্দুস্তানি রাগ সঙ্গীতের বিশেষ প্রভাব দেখা গিয়েছে। প্রসঙ্গত, বাংলা গানে ঠুমরি (Thumri) ধারার প্রবর্তন তাঁরই হাতধরে। এছাড়া বাংলার প্রথম গজলও (Gazal) রচনা করেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেনই।
'খামখেয়ালী সভা'র সদস্য
নিজের দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে বহু বিশিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)। রবিঠাকুরের সঙ্গে ভীষণ নিবিড় সম্পর্ক ছিল অতুলপ্রসাদের। একসময় 'খামখেয়ালী সভা' গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন অতুলপ্রসাদ। তাছাড়াও সেই সভার অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে যাঁদের নাম না বললেই নয় তাঁরা হলেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (Dwijendralal Roy), মহারাজা জগদীন্দ্রনারায়ণ রায়, লোকেন্দ্রনাথ পালিত প্রমুখ। এক একদিন এক একজন সদস্যের বাড়িতে বসত সভা। শোনা যায়, একবার সভা বসেছিল অতুলপ্রসাদ সেনের বাড়িতে। সেইদিন রাত ১২টার পর বাড়ি ফিরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সহ কয়েকজন তো সেদিন বাড়িই ফেরেননি। সারারাত চলেছিল গান বাজনার আসর।
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্মলগ্নের সাক্ষী
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের আরও কাহিনী রয়েছে। শান্তিনিকেতনেও (Shantiniketan) সাক্ষাৎ হয়েছে উভয়ের। পরস্পরকে শুনিয়েছেন নিজেদের সৃষ্টি। আর একবার কুমায়নে থাকাকালীন অতুলপ্রসাদ সেনকে ডেকে পাঠিয়েছেলেন রবীন্দ্রনাথ। বর্ষামুখর এক বিকেলে বসেছিল কবিতা-গানের আসর, যা চলেছিল প্রায় রাত্রি ১০টা পর্যন্ত। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের 'এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর' গানটির জন্মলগ্নের সাক্ষী ছিলেন অতুলপ্রসাদ। লুকিয়ে দেখেছিলেন কবির সঙ্গীত সৃষ্টি। পরে সেই কথা জানিয়েছিলেন কবিকে।
ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়
সারা জীবন গানের মধ্যে দিয়ে আনন্দ বিনিময় করলেও ব্যক্তিগত জীবন খুব একটা সুখী ছিলেন না অতুলপ্রসাদ সেন। মা-কে কেন্দ্র করে বিবাদের জেরে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটে। ফলে জীবনের অনেকটা সময় একাই থাকতে হয়েছে তাঁকে। আর ব্যক্তিগত জীবনের সেই বিষাদের সুর ধরাও পড়ছে তাঁর বেশকিছু গানে। তবে শত কষ্টের মাঝেও সৃষ্টি থেমে থাকেনি। কিন্তু কালের নিয়ম যে বাঁধা, যা মেনে নিতে হয় সবাইকেই। আর সেই নিয়ম মেনেই ১৯৩৪-এর ২৬ অগাস্ট চিরতরে থেমে গেল অতুলপ্রসাদ সেনের জীবন গান।