'ছোট থেকেই গাড়ি চালানোর ইচ্ছে, নিজের একটা গাড়ি হবে, এই স্বপ্নই দেখতাম। এখনও সেই স্বপ্নই দেখি।', শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে বলছিলেন রেবা।
গত চারবছর ধরে কলকাতায় গাড়িই চালাচ্ছেন রেবা। তবে তাঁর স্বপ্নপূরণ এখনও হয়নি। কারণ ট্যাক্সি চালিয়ে নিজস্ব একটা গাড়ি এখনও কিনে উঠতে পারেননি তিনি। সেই স্বপ্নপূরণের জন্যই প্রাণপাত করছেন কলকাতার প্রথম মহিলা অ্যাপ ক্যাব ড্রাইভার এই কন্যা। তাঁর জীবন চলে নিজস্ব শর্তে।
রেবাই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গোলাপি ট্যাক্সির চালকদের একজন! তাঁর গাড়ির নম্বর ডব্লিউ বি ১৯ জে ৯৮৯৪। বছরখানেক আগে রাজ্য সরকার ঘোষণা করে, শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য চালু হবে ট্যাক্সি। সেই তালিকায় প্রথম নাম ওঠে তাঁর। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই কাজে নেমে পড়েন তিনি। প্রথমে অনেকেই দেখে অবাক হয়েছেন। মেয়ে ড্রাইভার রাত বিরেতে গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু ওসব মাথায় নেননি তিনি। ভাবলে পেট চলবে না যে। তাই রেবা শহরের রাস্তায় ছোটাচ্ছেন পিংক ক্যাব।
শ্বশুরবাড়ির লাগাতার অত্যাচার লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল একটা সময়। যেকারণেই সব ছেড়েছুড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নেপালগঞ্জের বাড়িতে ফিরতে হয় তাঁকে। গাড়ি চালানোর ইচ্ছে তো ছিলই। নামও লেখান মোটর ট্রেনিং স্কুলে। বাড়িতে বলতেন, কম্পিউটার শিখতে যাচ্ছেন। কিন্তু রেবা কয়াল মণ্ডল ঠিক করে ফেলেন, ট্যাক্সিই চালাবেন। পাক্কা চারবছর ধরে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন তিনি। তাঁকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন 'আজাদ ফাউন্ডেশন'। ওই এনজিওর তরফেই তাঁকে ইএমআই-তে গোলাপি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
বাপের বাড়িতে বাবা-মা, তিন দাদা-বৌদি, ভাগ্নে-ভাগ্নি নিয়ে সংসার রেবার। তাঁর কথায়, 'পুরুষ ড্রাইভাররা আমাকে প্রথমে মেনে নিতে পারত না। যাত্রীরাও অনেক খারাপ ব্যবহার করত। এমনও হয়েছে যে, গাড়ি নিয়ে রাতে ফিরছি অটোচালক বা বাইক আরোহীরা আমায় উত্যক্ত করত। ওরা মেনে নিতে পারত না। বুকিং ঢোকার পর অনেকেই আমার গলা শোনার পর অবাক হয়ে যেত।' তবে এই শহরে প্রতিদিন বহু ভালো মানুষও দেখেন রেবা।
জন্মের পর থেকেই সঙ্গী হয়েছিল বঞ্চনা। অল্প বয়সেই থেমে গিয়েছিল পড়াশোনা। গাড়ি চালানো শুরুর পর একদিন দুপুরে লেকমলের পেছনে একজন যাত্রীকে একটি ক্যাফেতে পৌঁছে দিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন রেবা। তাঁকে নিয়েই ফেরার কথা রেবার। গাড়িতেই টিফিন বক্স খুলছিলেন রেবা। আচমকা দেখেন দুজন পৌঢ়া তাঁর গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। রেবার কাছে এসে তাঁরা জানতে চান, 'আমরা ব্যালকনি থেকে আপনাকে দেখছিলাম, আপনি কী এই গাড়ির ড্রাইভার।' উত্তর দেওয়ার পর ওই মহিলারা রেবাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চান। এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করেন। যা এখনও ভুলতে পারেন না রেবা।
গোটা কলকাতার রাস্তাঘাট এখন হাতের তালুর মতো চেনেন রেবা। আগে যে পুরুষ ড্রাইভাররা তাঁকে উত্যক্ত করত, এখন তাঁরাই রেবাকে রাস্তা চিনতে সাহায্য করে। আর গুগল ম্যাপ দেখতে হয় না। এই চারবছরে গাড়িতে বহু ফেলে যাওয়া স্মার্টফোন ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। বহু রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। রাতে বহু মহিলাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন।
রেবা চান, আরও মহিলা এই পেশাকে বেছে নিক। কারণ কলকাতায় কর্মরত মহিলাদের সংস্থা বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে কখনও ভোরের শিফ্ট আবার কখনও বাড়ি ফিরতে গভীর রাত। সে দিক থেকে মহিলা ড্রাইভার সাহায্যের নতুন দিগন্ত আনবে বলে মত তাঁর। প্রধানত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের লড়াকু মেয়ে রেবা পরিজন-প্রতিবেশীদের ব্যঙ্গ-কটাক্ষের তোয়াক্কা না করে স্টিয়ারিং ধরে ফেলেছেন। যাত্রাপথ কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। প্রতিবন্ধকতায় ভরা সেই পথ পেরিয়ে রেবা আজ গড়ে তুলেছেন নিজের অস্তিত্ব।
আরও পড়ুন- দুর্গাপুজোর আগে গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রো? এপ্রিলেই শুরু প্রস্তুতি