ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) মানে লড়াই। এমনটাই দাবি করেন ক্লাবের কর্তা ও সমর্থকরা। কিন্তু দিনে দিনে দেশভাগ ও পূর্ব বঙ্গের মানুষের কলকাতা ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছে লাল-হলুদের নাম। দেশভাগের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে। তবে ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্টা পায় ১৯২০ সালে। কীভাবে দেশভাগের সঙ্গে জড়াল এই ক্লাবের নাম?
ইস্টবেঙ্গলের প্রবীন সমর্থক কুশল চক্রবর্তী মনে করেন, দেশভাগের আগে থেকেই এই পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের কিছুটা পার্থক্য ছিল। তবে তা কখনই ধর্মের ভিত্তিতে নয়। তাঁর মতে, 'পূর্ব বঙ্গে যারা থাকতেন তাদের সকলেই কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত করতে পারতেন না। যারা আসতেন তাদেরকেও বেশ কষ্ট করেই কলকাতা শহরে প্রতিষ্ঠা পেতে হত। শহরের মানুষ খুব ভালভাবে গ্রামের লোকেদের সাদরে বরণ করতেন এমনটা একেবারেই নয়।'
পাশাপাশি তিনি এও বলেন, 'সবাই কিন্তু কলকাতায় প্রতিষ্টা পেতেন এমনটা নয়, মূলত শিক্ষা, বা অর্থে বলিয়ান মানুষরাই জায়গা করে নিতে পারতেন এ শহরে। শুধু ব্যবসা বা চাকরি ক্ষেত্রে নয়, খেলাধুলোতেও এর প্রভাব পড়েছিল।' ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের অনেক ফুটবলারই সেই সময় কলকাতায় এসে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। এমনকি ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের পেছনেও আট বাঙাল ফুটবলার ছিলেন। শুধু মোহনবাগানে নয়, কলকাতা শহরের বিভিন্ন ক্লাবেই খেলতেন পূর্ব বঙ্গের ফুটবলাররা। তবে তারা যোগ্য হলেও অনেকসময়ই সুযোগ দেওয়া হত না তাদের। ফলে, ক্ষোভ বাড়তে থাকে। সেখান থেকেই পটভূমি তৈরি হয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তৈরির।
১৯২০-র ২৯ জুলাই বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের নাগরপুরের জমিদার সুরেশ চৌধুরীর কলকাতার জোড়াবাগানের বাড়িতে নতুন ক্লাব গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেদিনের সভায় ছিলেন তিন বিখ্যাত খেলোয়াড় শৈলেশ বসু, নসা সেন ও অরবিন্দ বসু। ক্লাবের নাম কী হবে? শৈলেশ বসু মত দিয়েছিলেন, নাম রাখা হোক 'ইস্টবেঙ্গল'।
কিন্তু এমন নাম কি প্রদেশিকতাকে প্রশ্রয় দেবে? প্রথমে গররাজি হলেও পরে মত দেন সুরেশ চৌধুরী। কেন মত দিয়েছিলেন? আসলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একটি পারিবারিক ক্লাব ছিল। এখন যেখানে চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল, সেখানেই ওঁর বাড়ি আর ক্লাব। যে ক্লাবে বন্ধুরা মিলে তাস, দাবা খেলতেন। শখ করে চিত্তরঞ্জন নাম রেখেছিলেন 'ইস্টবেঙ্গল'। কোনও কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
ক্লাব প্রতিষ্ঠা হলেও ব্রিটিশ রোষ থেকে ছাড় পায়নি ইস্টবেঙ্গল। চলার পথে পদে পদে কাঁটার বেড়া। প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, এমনকী ১৯৩০ সালে দ্বিতীয় ডিভিশনে সব ম্যাচ জেতার পরেও অসহযোগ আন্দোলনের দোহাই দিয়ে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা না করা- প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর তখন ইস্টবেঙ্গলের সামনে। প্রতিবাদে ক্লাবের কর্তা, সদস্য, সমর্থকরা মশাল নিয়ে অভিনব মিছিল করে ঘেরাও করেছিলেন ধর্মতলার আইএফএ অফিস। সেদিন অপরাহ্নের অস্তমিত সূর্যে প্রায়ান্ধকার ময়দানে জ্বলে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী মশাল। তার রং লাল আর সোনালি। তার শিখা যেন আন্দোলনের প্রতীক। ইস্টবেঙ্গলের প্রতীক হয়ে গেল সেই মশালই। ক্লাব প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যার জন্ম।