২০২০ সাল বিশ্ববাসীর কাছে সত্যিই স্মরণীয় এক বছর। গোটা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে মহামারি। ইতিমধ্যেই অভিশপ্ত তকমা পেয়েছে ২০২০। বিশ্বে করোনার সবচেয়ে প্রভাব পড়েছিল মার্কিন মুলুকে। তবে এবছর আমেরিকা কেবল কোভিড জ্বরেই কাবু ছিল না। আরও দুটি ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। যার মধ্যে টানটান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেমন রয়েছে। তেমনি বলতে হয় এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে ওঠা গোটা মার্কিন মুলুকের কথা।
আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী আমেরিকায় প্রতি বছর পুলিশের হাতে মারা যায় ১,২০০ ব্যক্তি। কিন্তু ৯৯ শতাংশ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয় না।তবে গত ২৫ মে পুলিশের নির্যাতনে এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল ট্রাম্প সরকারের ভিত।
গত ২৫ মে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড-কে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। ক্রমাগত হাঁটুর চাপে ঘাড়ে ও পিঠে সংকোচনের কারণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড। মিনিয়াপলিসের এক পুলিশ অফিসার নিরস্ত্র ফ্লয়েডকে মাটিতে ফেলে, হাঁটু দিয়ে ঘাড় চেপে ধরেন। আট মিনিটের উপর এ ভাবে হাঁটুর চাপে শ্বাসরোধে মৃত্যু হয় ফ্লয়েডের। পুলিশ অফিসার ডেরেক চৌভিনের হাঁটুর চাপে ফ্লয়েডের মৃত্যু হওয়ায়, তাঁর বিরুদ্ধে থার্ড-ডিগ্রি মার্ডার ছাড়াও নরহত্যার অভিযোগ দায়ের হয়। বাকি তিন অফিসারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এরপর শুরু হয় বিক্ষোভ, প্রতিবাদ। গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের একাধিক ঘটনা ঘটে। মিনিয়াপলিস থেকে প্রথম বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জায়গাতেও। হাতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে অনেকে নীরব প্রতিবাদও জানান। এর জেরে অস্বস্তিতে পড়তে হয় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে। ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক-সহ ৪০টির বেশি শহরে জারি করতে হয় কার্ফু। ৬টি প্রদেশে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ডাকা হয় ন্যাশনাল গার্ডকে।
আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল , মার্কিন পুলিশের একাংশের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব ক্রমশ বাড়ছে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন। এই মনোভাব মার্কিনি মুক্ত চিন্তার আদর্শের বিরোধী। বিক্ষোভকারীদের অনেকের হাতে আই ক্যান নট ব্রিদ ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার লেখা পোস্টার দেখা গিয়েছিল।
করোনার প্রবল সংকটের সময়ই দিকে দিকে জ্বলতে থাকে বিক্ষোভের আগুন। দীর্ঘ দিন ধরে কালো ও বাদামি চামড়ার মানুষদের একটা শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে, তাদের ওপর নজরদারি চালানো হয়েছে, তাদের গণনির্যাতন করা হয়েছে, দমবন্ধ করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হয়েছে, খুন করা হয়েছে। এই অভিযোগ তুলে পথে নামেন মানবাধিকার আন্দোলনকারীরাও। আমেরিকার সমাজে যে বৈষম্য শেকড়ের গভীরে সেখানে পরিবর্তন আনার দাবি তোলা হয়।
আমেরিকায় গণসহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আদিবাসী আমেরিকানদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের গণহত্যা চালানো এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রীতদাস বানানোর ইতিহাস তো আছেই। এর বাইরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের সঙ্গে এক হয়ে আমেরিকান সেনারা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সর্বশেষ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে হত্যা ও নির্যাতন চালানোর বিষয়েও আমেরিকান সেনারা ভয়ঙ্কর নজির রেখেছে। ফ্লয়েডের মৃত্যু বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে জাতি হিংসা।
ফ্লয়েডের পর গত অগস্টে জ্যাকব ব্লেক নামে আরও এক কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন করে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে আমেরিকা! নতুন বিক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে মার্কিন মুলুক।
বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনকে গোড়া থেকেই দমনমূলক নীতিতে দেখেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আন্দোলনের জন্য অতি-বামপন্থীদের দায়ী করেছেন ট্রাম্প। আমেরিকায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠনগুলির জোট অ্যান্টিফা বিক্ষোভকারীদের উস্কানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ট্রাম্প।
তবে সেই বিক্ষোভের আঁচ গিয়ে পড়ে হোয়াইট হাউসেও। ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউজের বাইরে বিক্ষোভকারীরা উপস্থিত হওয়ার পর যখন পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুরক্ষায় তাঁকে হোয়াইট হাউজের আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা গেছে, ওই বাঙ্কার থেকে তাঁকে ওপরে তোলার পরেও নাকি বেশ আতঙ্কেই ছিলেন মার্কিন সর্বেসর্বা। প্রায় ঘণ্টাখানেক মাটির তলায় ঘাপটি মেরে থাকতে হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। হোয়াইট হাউজের বাইরে যেভাবে মানুষের বিক্ষোভ আছড়ে পড়ে তা দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা।
প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, গ্রিস, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও। জার্মানি, ব্রিটেন ও কানাডা সরকারও আমেরিকায় বর্ণবাদের নিন্দা করার পাশাপাশি যেভাবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর পুলিশি আক্রমণ নেমে আসে, তার কড়া সমালোচনা করে। রাষ্ট্রসংঘও মার্কিন প্রশাসন ও পুলিশের অকারণ, মাত্রাছাড়া শক্তিপ্রয়োগের নিন্দা করে।