ভাঙন তীব্র হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। প্রথম ধাক্কাটি ছিল মমতার আন্দোলনের প্রথম দিনের সঙ্গী ও তৃণমূলের একসময়ের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড মুকুল রায়ের দল ছাড়া।
মুকুল রায় থেকে শুরু। বর্তমানে শুভেন্দু। একের পর এক পরিচিত মুখ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী ছেড়ে চলেছেন। ২০১৪-র পর থেকেই মোটামুটি একটু করে ভাঙন ধরেছে।
গত ৬-৭ বছরে তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন ঘাসফুলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মুখ। দেখে নেওয়া যাক, কারা রয়েছেন, এই তালিকায়।
মুকুল রায়: ১৯৯৭ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্নে নথিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। তারপর মমতা-ব্রিগেডের দ্বিতীয় মুখ হয়ে ওঠেন অচিরেই। তৃণমূল কংগ্রেস ও মুকুল রায় ছিল সমার্থক। কাট টু ২০১৭ সাল। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন মুকুল। তৃণমূল-মুকুল সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি যোগ দেন মুকুল রায়।
শোভন চট্টোপাধ্যায়: মমতার স্নেহের কানন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব আন্দোলনের সঙ্গী অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। ২০১৯ সালে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভনের সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ঘিরে নানা শোভনের ব্যক্তিগত জীবনে নানা অশান্তি তৈরি হয়। শোভনের সাংসারিক অশান্তি ড্রয়িং রুম ছাড়িয়ে দলীয় কাজেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় দলীয় বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শোভন নিয়ে। সেই বছরেই মোটামুটি মমতার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে শোভনের। তৃণমূলের সঙ্গেও। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেন শোভন।
শুভেন্দু অধিকারী: তৃণমূলে জননেতার তালিকা করলে, মমতার পরেই নাম ছিল শুভেন্দু অধিকারীর। কাঁথির অধিকারী পরিবারের সঙ্গে মমতা বা তৃণমূলের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। সেই শুভেন্দু অধিকারীও তৃণমূলে কোণঠাসা হওয়ার অভিযোগ জানাতে শুরু করেন। মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুভেন্দুর তিক্ত সম্পর্কের জেরে শুভেন্দুর দীর্ঘ দিন ধরেই তৃণমূল কংগ্রেস থেকে দূরত্ব বজায় রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেন। শুভেন্দু-তৃণমূল সম্পর্ক আরও তলানিতে যায়, বিধানসভায় প্রশান্ত কিশোরকে ভোট কুশলীর দায়িত্ব দেওয়ার পরে। বারবার তাঁর মানভঞ্জনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাতত শুভেন্দু অধিকারী ও তৃণমূলের সম্পর্ক শেষ। বিজেপি-তে শুভেন্দুর যোগ দেওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
অর্জুন সিং: ২০১৯-এর মার্চে ঠিক লোকসভা ভোটের আগে ভাটপাড়ার দর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিং যোগ দেন বিজেপি-তে। মুকুল রায় ও কৈলাস বিজয়বর্গীয়র হাত ধরে গেরুয়া পতাকা তুলে নেন। ব্যারাকপুরে লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন অর্জুন। কিন্তু ওই কেন্দ্রে দীনেশ ত্রিবেদীর উপরই আস্থা রাখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলনেত্রীর এহেন সিদ্ধান্তে প্রকাশ্যে রা না কাড়লেও অর্জুন ক্ষুব্ধ হন।
মিহির গোস্বামী: একাধিক বার সোশ্যাল মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যমের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সরাসরি বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস আর সেই দল নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতের বাইরে চলে গিয়েছে দল। কোচবিহার দক্ষিণের এই বিধায়কও মমতার দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সঙ্গী। দুঁদে নেতা হিসেবেই পরিচিত। ভাবমূর্তিও স্বচ্ছ। তৃণমূলে অবহেলিত, অপমানিত হওয়া ও প্রশান্ত কিশোরের উপর একরাশ ক্ষোভ উগরে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দল ছাড়েন মিহির। দিল্লিতে গিয়ে যোগ দেন বিজেপি-তে।
সব্যসাচী দত্ত: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একসময় ঘনিষ্ঠ মহলেই বিরাজ করতেন সব্যসাচী দত্ত। রাজারহাট-নিউটের তৃণমূল বিধায়ক ছিলেন। বিধাননগরের মেয়রও ছিলেন। ২০১৯ সালের শুরু থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু হয় সব্যসাচীর। সব্যসাচী ইস্তফা দেন মেয়রের পদে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে যোগ দেন বিজেপি-তে।
শীলভদ্র দত্ত: ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত। প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানান ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের বিরুদ্ধে। নভেম্বরের শুরুতেই মুখ খোলেন তিনি। বলেন, 'একটা বাজারি কোম্পানি এখন এখানে টাকা নিয়ে ভোট করাতে এসেছে। তারা আমাকে বলছে আপনাকে ভোট নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না। ভোট আমরাই করাব। ৯-১০ বছর বয়স থেকে রাজনীতি করছি, আর আমাকে এখন রাজনীতির জ্ঞান দিচ্ছে। আমি এই পরিবেশে আর মানিয়ে নিতে পারছি না।' সূত্রের খবর, শীলভদ্রও তৃণমূল ছাড়ার পথে।