পৌষ সংক্রান্তির দিন শতাব্দী রায় ফ্যান ক্লাব নামের এক ফেসবুক পেজে তৃণমূলকে নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেছেন, মনে হয় কেউ কেউ চায় না আমি মানুষের কাছে যাই। তিনি আরও লেখেন, ‘আমি আমার কর্তব্য পালনের চেষ্টা করে যাব। যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিই আগামী ১৬ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার দুপুর দুটোয় জানাব।” শতাব্দী রায়ের এই পোস্টের পর রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
তার মাঝেই শতাব্দী রায়ের আচমকাই দিল্লী সফর তৃণমূলে নতুন করে অস্বস্তি সৃষ্টি করল। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও শতাব্দী রায় কি একই পথে এগোচ্ছেন! ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ইতিমধ্যে বেসুরো বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ফেসবুক পোস্ট করে জানিয়েছেন, আগামী শনিবারই বিকেল ৩টেয় ফেসবুক লাইভে এসে নিজের ‘অবস্থান’স্পষ্ট করবেন তিনি। ঠিক সেদিনই মন্ত্রীর পাশাপাশি দলীয় সাংসদ শতাব্দীও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ঘোষণা করলেন। যাতে বিধানসভা ভোটের আগে নতুন করে ‘সিঁদুরে মেঘ দেখছে’ তৃণমূল শিবির।
একটা সময় টলিউডের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয়। তৃণমূলনেত্রীর সভা হলেও তাতে উপচে পড়ত টলিউডের তারকাগের ভিড়। তেমনি রূপোলি জগত থেকে রাজনীতিতে পা বারিয়েছিলেন শতাব্দী। বলতেই হবে শতাব্দী রায় বাংলা সিনেমা জগতের একজন প্রথম সারির অভিনেত্রী। তার সময়ে তিনি দাপটে বাংলা ছবির জগতে রাজত্ব করে গেছেন।
বাংলা ছবিতে নায়িকা হিসেবে শতাব্দী রায়ের আত্মপ্রকাশ আটের দশকের শেষের দিকে। নয়ের দশক পর্যন্তও তিনি ছিলেন জনপ্রিয় নায়িকা। ওই বাংলা ছবির অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক তাপস পালের সঙ্গে একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন। এই হিট জুটির দু’টি ছবি বক্স অফিস সাফল্য এনে দিয়েছিল। এছাড়াও প্রসেঞ্জিত, চিরঞ্জিত, অভিষেকের সাথেও তিনি জুটি বেঁধে বহু অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি পেইন্টিং এবং কবিতা লেখাতেও সমান পারদর্শী। তার বেশ কিছু কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
তাপস-শতাব্দী যুগলবন্দি রুপোলি পর্দার বাইরে রাজনীতির অঙ্গনেও নজর কেড়েছিল । ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কিংবা ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাপস-শতাব্দী একের পর এক তৃণমূলের প্রচার সভা করেছেন। ফিল্মি দুনিয়ার বাইরে সংসদেও এই জুটিকে দশ বছর দেখেছে বাংলার আমজনতা।
১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর আগারপাড়ায় শৈলেন এবং নীলিমা রায়ের পরিবারে জন্ম শতাব্দীর। সরোজিনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত যোগমায়া দেবী কলেজে।
আতঙ্ক সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন শতাব্দী রায়, এই ছবির পরিচালক ছিলেন তপন সিন্হা। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে (এর পূর্বে তিনি দিনেন দাসগুপ্ত পরিচালিত “টিনা” নামক একটি সিনেমায় অভিনয় করেন, যা মুক্তি পায় নি)। এরপর গুরুদক্ষিণা, আপন আমার আপনের মত ন জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে সাধারণ দর্শকের মনে জায়গা করে নেন শতাব্দী। ২০০৯ সালে তিনি একটি কল্পবিজ্ঞান নির্ভর চলচ্চিত্র “ফ্রেন্ড” সিনেমার পরিচালনা করেন, তাতে অভিনয়ও করেন। কিন্তু সেই সিনেমা সেরকম ভাবে সাড়া পায় নি। এরপর থেকেই রাজনীতির জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অভিনেত্রী।
দীর্ঘদিন অভিনয়ের পর ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে ১৫ তম লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। ওই বছরেই রেলওয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪-য় ১৬তম লোকসভা নির্বাচনে শতাব্দী পুনরায় নির্বাচিত হন। এবং নারী কল্যাণ ও ন্যায় বিচার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসাবে বহু কাজ করেন। ২০১৯ সালে প্রবল বিজেপি হাওয়াতেও নির্বাচনী লড়াইয়ে হ্যাট্রিক করে বীরভূম থেকে সাংসদ হন শতাব্দী।
২০০৯ সালের প্রথমবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েই বীরভূমআসন থেকে ৬১ হাজার ৫১৯ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন শতাব্দী রায়। তৃণমূলনেত্রীর সঙ্গে বরাবরই ভাল সম্পর্ক তাঁর। কয়েকদিন আগে বোলপুরে পদযাত্রা করেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে নেত্রীর পাশেই দেখা গিয়েছিল শতাব্দীকে। মিছিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মমতার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে হেঁটেছিলেন শতাব্দী।
তবে এর আগে বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছিল শতাব্দীকে। সেটা ২০১৮ সালের ঘচনা। কুকথাতেই অনুব্রত মণ্ডল ‘স্টার’ হয়ে উঠেছেন। এটাই তাঁর ব্র্যান্ড। বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সভাপতির বিরুদ্ধে এভাবেই সরব হয়েছিলেন জেলার সাংসদ শতাব্দী রায়। বীরভূমের সাংসদ হলেও শতাব্দীর সঙ্গে অনুব্রতর সম্পর্ক নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে বরাবরই প্রশ্ন ছিল।
একাধিকবার সংঘাত হয়েছে শতাব্দী-অনুব্রতর। কখনও কখনও প্রকাশ্যেও এসেছে পরস্পরের মতপার্থক্য। বাগ্যুদ্ধও হয়েছে সাংসদ বনাম সভাপতির। শতাব্দীর গোষ্ঠী অভিযোগ করেছে, সাংসদকে এড়িয়েই কর্মসূচি নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্নেহধন্য’ অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডল। সাংসদ শতাব্দী অনুব্রতর বিরুদ্ধে দলের অন্দরে অভিযোগ করলেও তাতে কাজ হয়নি। এবার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁকে ডাকা হয় না বলে নাম না করেই দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কার্যত নিজের ক্ষোভ স্পষ্ট করেছেন শতাব্দী৷
একসময় সারদাকাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল শতাব্দী রায়ের। সারদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন তিনি। এনিয়ে সারদাকাণ্ডে শতাব্দীকে সিজিও দফতরে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। শকাব্দী নিজেই জানিয়েছিলেন সারদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে ৪২ লক্ষ টাকা নেওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু টিডিএস কেটে তিনি পেয়েছিলেন ২৯ লক্ষ টাকা। সেই ২৯ লক্ষ টাকাই ইডির হাতে শতাব্দী তুলে দেন।
“শতাব্দী ফাউন্ডেশন” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজ কর্ম করে থাকেন। তার স্বামী মৃগাঙ্ক বন্ধ্যোপাধ্যায় একজন মার্কেটিং এক্সেকিউটিভ। তার ছেলের নাম সাম্যরাজ (তোজো) এছাড়াও এক কন্যা সন্তান রয়েছে শতাব্দীর, নাম সামিয়ানা বন্দ্যোপাধ্যায় (ঝুমি) । যদিও শতাব্দী রায় শুধুই একজন অভিনেত্রী বা রাজনীতিবিদ নন। একইসঙ্গে তিনি প্রযোজক, পরিচালক এবং কবিও।