scorecardresearch
 

আগামী ৫ বছর বাংলা শাসনের জিওনকাঠি! মতুয়া মন পেতে একই পথে শাহ-মমতা

বঙ্গ রাজনীতির টানা পোড়েনে আজ অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক। অতীতে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়তো কখনও হতে হয়নি মতুয়া ভক্তদের। বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে? তা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন তৃণমূল ও বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরের কাছেই। কারণ ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে নবান্ন দখল করতে হলে এই ভোটব্যাঙ্কই হতে পারে অন্যতম তুরুপের তাস। আর তাই জানুয়ারিতে বঙ্গ সফরে এসে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে যাচ্ছেন অমিত শাহ।

Advertisement
বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে? বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে?
হাইলাইটস
  • বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে?
  • তা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন বিজেপি ও তৃণমূল দুই শিবিরের কাছেই
  • নবান্ন দখল করতে হলে এই ভোটব্যাঙ্কই হতে পারে অন্যতম তুরুপের তাস

বঙ্গ রাজনীতির টানা পোড়েনে আজ অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক। অতীতে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়তো কখনও হতে হয়নি মতুয়া ভক্তদের। বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে? তা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন তৃণমূল ও বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরের কাছেই। কারণ ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে নবান্ন দখল করতে হলে এই ভোটব্যাঙ্কই হতে পারে অন্যতম তুরুপের তাস। আর তাই জানুয়ারিতে বঙ্গ সফরে এসে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে যাচ্ছেন অমিত শাহ। 

ঘাসফুলে বিদ্রোহের ছাইচাপা আগুন, মেদিনীপুরের পর হাওড়ায় শাহ'র সভায় থাকবে চমক?

বাম আমলে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট সেভাবে আলাদা করে চিহ্নিত হতো না। তবে কালক্রমে মতুয়াদের মধ্যে তৃণমূলের প্রভাব বাড়তে দেখে বাম জমানার শেষ দিকে  ঠাকুরবাড়িতে প্রভাব বিস্তারের  ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল বাম শিবির। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট থেকেই ঠাকুরবাড়িতে তৃণমূলের প্রভাব অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে সেবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের  ঘাঁটি বলে পরিচিত দুই ২৪ পরগনা এবং নদিয়ায় অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলও বলছে, ওই তিন জেলায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল  তৃণমূলের। বামেদের প্রভাব কার্যত ছিলই না । 

মেগা শো হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ! বক্তৃতা না দিয়েই সভায় ইতি শুভেন্দুর

অতীতে ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা তথা মতুয়াদের ধর্মগুরু প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে বিধায়ক, মন্ত্রী ও সাংসদ হয়েছিলেন। তিনি বিধায়ক হয়েছিলেন কংগ্রেস থেকে দাঁড়িয়ে। সাংসদ হয়েছিলেন বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে। পরে অবশ্য ফের কংগ্রেসে ফিরে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে জিতে মন্ত্রীও হন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণকে। মতুয়া ভোটব্যাঙ্কও অকাতরে ঘাসফুলের পক্ষেই রায় দিয়েছিল ইভিএমে। যার ভরসায় একের পর এক ভোটে কিস্তিমাত করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন্তু ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন থেকেই মতুয় ভোট ব্যাঙ্ক নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে ধীরে ধীরে রূপরেখা সাজিয়েছে ভারতীয় জনতাপার্টি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগেই মঞ্জুলকৃষ্ণ মমতা  মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে বিজেপি শিবিরে নাম লেখান। তাঁর ছেলে সুব্রতও তৃণমূল ছেড়ে যোগ দেন  বিজেপিতে।  সেবার  বনগাঁ কেন্দ্রে সুব্রতকেই তুরুপের তাস করেছিল বিজেপি। অন্য দিকে, তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়েন প্রয়াত সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী মমতা। জেঠিমা-ভাইপোর লড়াই সরাসরি এসে পড়ে  ভোটের ময়দানে। সেই সূত্রেই মতুয়াদের বড়মা বীণাপাণি ঠাকুরের সংসারে রাজনৈতিক বিভাজনের ছবিটা সামনে এসে পড়েছিল। দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল মতুয়া ভক্তেরাও। সেবার প্রবল তৃণমূল হাওয়ায় বনগাঁতে ফুটেথিল ঘাসফুল। কিন্তু ২০২১ সালের চিত্রটা অনেকটাই বদলেছে। যা চিন্তায় রেখেছে ঘাসফুল শিবিরকেও।

Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শান্তনু ঠাকুর
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শান্তনু ঠাকুর

ফরিদপুরের কৃষক পরিবারের সন্তান হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তন করেছিলেন বৈষ্ণব ধর্মের নতুন এই শাখা। হরিচাঁদের ছেলে গুরুচাঁদ তৈরি করেন মতুয়া সংগঠন। আর সেই সংগঠনকেই বিস্তার করেছিলেন বীণাপানি দেবী ও তাঁর স্বামী প্রমথরঞ্জন। দেশভাগের পর ঠাকুরনগরই হয়ে ওঠে মতুয়াদের নতুন ধর্মক্ষেত্র, নতুন ঠিকানা। অধিকার আদায়, নাগরিকত্ব আদায়। ধর্মক্ষেত্রে দাবি আদায়, স্বাভাবিকভাবেই ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করে রাজনীতি। স্বামীর মৃত্যুর পর মতুয়া সম্প্রদায়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বীণাপানি দেবী। মতুয়া সম্প্রদায়ের অধিকাংশরই নাগরিকত্ব নেই। দাবি আদায়ে অনশনেও বসেছিলেন বড়মা। বাম আমলে মেট্রো চ্যানেলের সেই আন্দোলনে আশ্বাস মিলেছিল বটে, তবে তা পূরণ হয়নি। তারপর থেকে প্রতি ভোটে, বারবার ঠাকুরবাড়ির উঠোনে পা রেখেছে রাজনীতি। ভোট মিটতেই ফের হারিয়েছে ভোটপাখিরা। কিন্তু কেউই মতুয়াদের উপেক্ষা করার সাহস দেখাতে পারেনি। হবে নাই বা কেন, রাজ্যের ২৯৪ বিধানসভা আসনের মধ্যে  প্রায় ৬০টি আসনে ফ্যাক্টর মতুয়ারাই। বাংলার ৪২ লোকসভা আসনের প্রায় ৬ থেকে ৭ আসনেও ফ্যাক্টর । 

২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঠাকুরবাড়ির আরও কাছে চলে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারবার ছুটে গিয়েছিলেন বড়মার কাছে। যা বজায় ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। ২০০৮ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত  মতুয়াদের একটা বড় অংশের সমর্থন বামেরা পেয়ে এসেছিল। ঠাকুর পরিবার থেকে কাকে ভোট দিতে হবে এমন কোনও নির্দেশ ২০১১ সালের  বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সে সময় থেকেই বড়মা তৃণমূল প্রার্থীদের ভোটে জেতানোর আবেদন জানিয়ে এসেছেন। তার সুফলও তৃণমূল পেয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেই সেই ভোটব্যাঙ্ককে নিশানা করেছে গেরুয়া শিবির। তাই  বড়মার আশীর্বাদ নিতে ঠাকুরবাড়ি  ছুটে যেতে দেখা গিয়েছে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও। এখন সেই বড়মা নেই। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পাঁচটি লোকসভার মধ্যে বনগাঁ ও ব্যারাকপুরে জয়লাভ করে বিজেপি। বনগাঁয় সাংসদ নির্বাচিত হন মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুর। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে এখন তাই তৃণমূল ও বিজেপি শিবিরের মধ্যে লড়াই চলছে মতুয়াদের কে বেশি কাছের তাই নিয়ে। 

শান্তনু ঠাকুর
শান্তনু ঠাকুর

হিসেব বলছে প্রায় ৩০টি বিধানসভা আসনের ফলাফল এদিক-ওদিক করে দিতে পারেন মতুয়ারা। অমিত শাহ বিধানসভা নির্বাচনে ২০০টি আসনের লক্ষ্যমাত্র দিয়ে রেখেছে। আর সেই ফল বাস্তবায়িত করতে গেরুয়া শিবিরকে মতুয়া ভোট পকেটে পুড়তেই হবে। গত লোকসভা নির্বাচনে মতুয়ারা বিজেপি-কে দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে মতুয়াপ্রধান দুই লোকসভা কেন্দ্র বনগাঁ ও রানাঘাটে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিল বিজেপি। বনগাঁয় শান্তুনু জেতেন ১ লাখের বেশি ভোটে। রানাঘাটে জগন্নাথ সরকার জয় পান ২ লাখেরও বেশি ব্যবধানে। এখন সেই ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখাই বিজেপির কাছে মূল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিজেপির এই গেমপ্ল্যানে প্রধান কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন সেই শান্তনু ঠাকুর। গত লোকসভা নির্বাচনে শান্তনু ঠাকুর মতুয়াদের নাগরিকত্বের লোভ দেখিয়ে ভোট নিয়েছিলেন। নাগরিকত্ব নিয়ে গাল ভরা অনেক আশ্বাস দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ২০১৯ এর মে থেকে ২০২০-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ বছর ৭ মাসে বিজেপি তা লাগু করতে পারেনি। আর মতুয়ারাও নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট পাননি। ফলে মতুয়াদের কোনও প্রশ্নের জবাব ছিল না মতুয়া সংঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরের কাছে। সেই কারণেই ২০২১-এর ভোটের আগে  বেঁকে বসেছেন শান্তনু।

Advertisement

নাগরিকত্ব আইন দ্রুত প্রয়োগ নিয়ে কিছু দিন ধরেই দলের উপরে চাপ বাড়াচ্ছিলেন শান্তনু ঠাকুর। দলের কর্মসূচি এড়িয়ে চলছিলেন। ‘বেসুরো’ শান্তনুকে নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছিল বিজেপির। গত ডিসেম্বরে বাংলায় এসে এ ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট বার্তা না দেওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সমালোচনা করতেও কসুর করেননি শান্তনু ঠাকুর। নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা নিয়ে নিজের মতামত জানাতে ৩০ জানুয়ারি মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ইতিমধ্যে শান্তনু ঠাকুরের মান ভাঙাতে বিজেপির রাজ্য নেতারা কোনও কসুর রাখছেন না। তাই মতুয়া ও উদ্বাস্তু অধ্যুষিত বনগাঁ  কেন্দ্রকে পৃথক সাংগঠনিক জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছে বঙ্গ বিজেপি । এ নিয়ে বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। বিধানসভার আগে ভোটব্যাঙ্কের  কথা মাথায় রেখে সেই দাবি এবার পূরণ করলেন দিলীপ ঘোষরা। বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার নতুন সভাপতি করা হয়েছে  শান্তনু ঠাকুর ঘনিষ্ঠ মানসপতি দেবকে। 

এদিকে  বিজেপি-র উপর শান্তনু যে ভাবে নিয়মিত ক্ষোভপ্রকাশ করে চলেছেন, তাতে ময়দানে নেমে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেসও। দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক শান্তনুকে তৃণমূলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন। শান্তনুর বিরোধী মমতাবালা ঠাকুরও প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, শান্তনু তৃণমূলে এলে তাঁর শান্তনুর সঙ্গে কাজ করতে কোনও আপত্তি নেই।  এদিকে মতুয়াদের মন পেতে তাঁদের একের পর এক দাবিকে মান্যতা দিয়ে চলেছেন  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মতুয়ারা সবাই এ দেশের নাগরিক। কারোর কোনও সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।  ডিসেম্বরে মতুয়া গড় বনগাঁয়া গিয়ে গত দশ বছরে মতুয়াদের যেসব দাবি রাজ্য সরকার মেনে নিয়েছে তার খতিয়ান দিয়েছে মমতা। জানিয়েছেন,  বাউড়ি, নমঃশূদ্রের পাশাপাশি মতুয়াদের জন্য উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। মতুয়াদের দাবি ছিল শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে ছুটি। সেই দাবিও মেনে নিয়েছেন মমতা। ২০২১-এ বঙ্গে মেরুকৃত ভোট হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। লড়াই হবে মূলত বিজেপি-তৃণমূলের। সেই মহাযুদ্ধে মতুয়া ভোট কোন পক্ষে যাবে তার ওপর নির্ভর করছে  নীলবাড়ির দখল কার কাছে থাকবে তার অনেকটাই। 


 

Advertisement