'আমরা সবাই তালিবান, বাংলা হবে আফগান।' সময়টা আটের দশক। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল অনেক বাংলাদেশি। ঠিক সেই সময় এই স্লোগান উঠেছিল সেই দেশে। সম্প্রতি আফগানিস্তান দখল করেছে তালিবান। তার জেরে বাংলাদেশের একাংশ তালিবানকে সমর্থন করছে। এতে সেই দেশে নতুন করে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গি তৎপরতা মাথা চাড়া দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে শেখ হাসিনা প্রশাসন।
বাংলাদেশে একাধিক মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। সেই দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন কায়েম হওয়ার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য। দেশের মৌলবাদী সংগঠনগুলি তালিবানদের আফগানিস্তান কব্জাকে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখছে। আর তার প্রভাব সোশ্যাল মিডিয়াতেও দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন : Afghanistan Taliban : মাঝ আকাশে প্রসব যন্ত্রণা আফগান মহিলার, তারপর যা হল...
সোশাল মিডিয়ায় প্রভাব
বাংলাদেশের বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া গ্রুপে তালিবানের সমর্থনে পোস্ট দেখা যাচ্ছে। অনেকেই প্রকাশ্যে তালিবানিদের প্রশংসা করেছেন। যেমন, রাশেদ কাঞ্চন নামে একজন তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, 'নিজের মাতৃভূমিকে বিদেশি শক্তির হাত থেকে মুক্ত করতে তালিবানদের দীর্ঘ ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা রয়েছে। আপনার? আপনি হলে কী করতেন? লড়তেন না-দেশের জন্য?' এ'রকম আর একটি ফেসবুক গ্রুপের পোস্টে দেখা গিয়েছে, 'বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশ আফগানিস্তানকে সমর্থন করছে। সময় মতো বাংলাদেশও করবে।' এই লেখা। অনেক পোস্টে আবার তালিবান ইস্যুতে পাকিস্তানের প্রশংসা করে ভারতের নিন্দাও করেছে কেউ কেউ।
আবার তালিবান বিরোধী পোস্টও বাংলাদশের ফেসবুক ইউজারদের পেজে দেখা গিয়েছে। যেমন, নাট্যকর্মী ও সাংবাদিক পাভেল রহমান তালিবানের ভয়ে আফগান নাগরিকদের দেশ ছেড়ে পালানোর কাবুল বিমানবন্দরের সেই দৃশ্য বর্ণনা করে ফেসবুকে লিখেছেন, 'আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে, একটি বিমানের ভিতরের দৃশ্য এটি। দেশ ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে। আহা! জীবন। রাজনীতি পুরো বিশ্ব এখন বুর্জোয়াদের দখলে, পুঁজিপতিদের হাতে। রাজনীতি যখন অসুস্থ হয়, তখন দেশ ভালো থাকে না। নিজের দেশ ছেড়ে পালানোর মতো এমন দুর্ভাগ্য কারও না হোক। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি নয়, মানুষের জন্য রাজনীতি হোক। প্রিয় বাংলাদেশ, শিক্ষা নাও; ভালো থেকো।'
সেই দেশেরই অনেকে আবার তালিবানিদের সমর্থন করার বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করেছে। তারা লিখেছে, 'এখন তালিবান জিতেছে বলে বাংলাদেশের অনেকেই তাদের সমর্থক হয়ে উঠেছে। লাদেনের সময়ও একই জিনিস দেখেছিলাম। কিন্তু, লাদেনকে যখন আমেরিকা লাথ মারল তখন এই লাদেন সমর্থকরাই পাল্টি খেল। এবারও তাই হবে।'
তালিবানের অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মৌলবাদীদের উজ্জীবিত করবে বলেই মত সেই দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষকদের। যেমন, নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড স্টাডিজের সফকত মুনির বলেন, 'আফগানিস্তানের জঙ্গিবাদের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য। কারণ, এদেশে অনেক মৌলবাদী সংগঠন রয়েছে। তালিবানরা যেভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে তাকে মৌলবাদীরা নিজেদের জয় হিসেবেই দেখতে শুরু করেছে। ঢাকা পুলিশও এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। তাদের তরফে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা তালিবানিদের উত্থানে উচ্ছ্বসিত। এতে দেশে জঙ্গিদের কার্যকলাপ বাড়তে পারে।'
আরও পড়ুন : তালিবানদের থেকে বেঁচে ভারতে আফগান মহিলা; কান্নায় ভেঙে পড়লেন MP
সফকত মুনিরের বক্তব্যের সত্যতা দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের একাধিক ফেসবুক পোস্টে। ইসলামপন্থী একাধিক ফেসবুক পেজে তালিবানের উত্থানকে 'আফগানিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ' বলা হচ্ছে। কেউ কেউ লিখছে, 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল কয়েক মাস। সেখানে তালিবানরা তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই করেছে প্রায় ২০ বছর। যা এক দৃষ্টান্ত।' অনেকের এও দাবি, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে তালিবানদের এই যুদ্ধকে সমর্থন করতেন। তাদের পাশে থাকতেন।
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
তালিবানদের নিয়ে নিজেদের অবস্থানের বিষয়ে গত ১৬ অগাস্ট বাংলাদেশ বিদেশমন্ত্রকের তরফে একটি বিবৃতি জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আফগানিস্তান সরকার এবং জনগণ যে সমর্থন দিয়েছে তা সব সময় বাংলাদেশ স্মরণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শীনীতি বাস্তবায়নে আফগানিস্তানের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।' বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম আবার বলেন, 'তালিবান তাদের অতীতের কালো অধ্যায় থেকে অনেকটাই সরে আসবে এমন প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ।'
পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন বাড়ছে বাংলাদেশে!
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রকাশ্যেই তালিবানকে সমর্থন করেছেন। আর তার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের গায়েও। সেখানকার অনেক মৌলবাদী সংগঠন আফগান ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করছে তা মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, পাকিস্তানের মদতকে মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না তিনি। আর যারা মৌলবাদকে সমর্থন করছে তিনি তাদেরও সতর্ক করেন।
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই ঢাকার তরফে ভারতকে সতর্ক করা হয়। সেখানকার পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম সেদিন জানান, বাংলাদেশের একদল যুবক আফগানিস্তানে যেতে চাইছে। তাদের লক্ষ্য, তালিবানের সঙ্গে হাত মেলানো। আর কাবুলে পৌঁছতে তারা ভারতের মাটিকে ব্যবহার করতে পারে। তাই BSF-কে সতর্ক করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : বাংলার ওপর দিয়ে তালিবান-যোগের সফর! সীমান্তে Alert BSF
বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া
তবে বাংলাদেশে তালিবানি সমর্থকদের রমরমার মধ্যেই আশার কথা শুনিয়েছেন সেই দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা। অধ্যাপক, আইনজীবী, চিকিৎসকের একাংশ সাফ জানিয়েছেন তাঁরা তালিবানের বিরুদ্ধে। যে কোনও মূল্যে তালিবানি শাসনের অপসারণ কাম্য বলেই মত তাঁদের। যেমন, চট্টগ্রাম পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন কলেজের বাংলার অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট কবি ফুয়াদ হাসান বলেন, 'আফগানিস্তানে তালিবানদের উত্থানকে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ সমর্থন করে না। তালিবানিদের নিয়ে তারা চিন্তিত। আমাদের দেশের অনেক মহিলা কাজ করে পেট চালান। তারা চাইবে না তালিবানি শাসন কায়েম হোক। মৌলবাদীরা তালিবানদের সমর্থন করছে হয়তো। তবে আমার বিশ্বাস সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ একত্রিত। শেখ হাসিনাও একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক-রাজনীতিবিদ। তিনি পরিস্থিতি ভালোই বোঝেন। সরকার নিশ্চয় এই বিষয়ে খেয়াল রাখছে। আমরাও আশা করি, বাংলাদেশের জনমানসে আফগানিস্তানের তালিবানি শাসনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী থাকবে না।'