বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সদ্য ঘোষণা করা হয়েছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লিগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ‘স্থগিত’ রাখা হল। কার্যত এটি একটি রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ২০২৫ সালে এসে আবারও ইতিহাস যেন ফিরে এল। কিন্তু এ ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। প্রায় সাত দশকের ইতিহাসে কমপক্ষে সাতবার নানা ভাবে নিষিদ্ধ, দমন বা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে এই দলটিকে। তবু, প্রতি বারই কোনও না কোনও ভাবে ফিরে এসেছে তারা।
আওয়ামী লিগের নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস, প্রতিবার কোনও প্রেক্ষিতে দলটির উপরে আঘাত এসেছে এবং কীভাবে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
১৯৫৮: প্রথম সামরিক শাসন, প্রথম নিষেধাজ্ঞা
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার আবহে পাকিস্তান সেনা প্রধান আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়ে যায় আওয়ামী লিগ-সহ অন্যান্য দল। দলের তৎকালীন নেতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি গ্রেফতার হন, শেখ মুজিবুর রহমান বারবার আটক হন। গণতন্ত্র চাওয়া ছিল ‘অপরাধ’।
১৯৬৬–৭১: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ
‘ছয় দফা’ দাবি তুলে শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার সুরে কথা বলেন। এর ফল— ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। যদিও প্রবল জনআন্দোলনে সরকার পিছু হঠে। কিন্তু তখনও আওয়ামী লিগ কার্যত নিষ্ক্রিয়, দলের বহু নেতা কারাগারে।
১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দল কার্যত নিষ্ক্রিয়
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর একাংশ। এরপর দীর্ঘ সময় আওয়ামী লিগ প্রকাশ্যে কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারেনি। জিয়া উর রহমান ও পরে এরশাদের শাসনে দলটির অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। শেখ হাসিনা তখন বিদেশে, নির্বাসনে।
১৯৮২–৯০: এরশাদ শাসনে দমন, শেখ হাসিনা গৃহবন্দি
১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন। আওয়ামী লিগ আবারও নিষিদ্ধ হয় না ঠিকই, কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করা হয়। শেখ হাসিনাকে বহুবার গৃহবন্দি রাখা হয়, সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দলীয় কর্মীরা গ্রেফতার, নির্যাতনের শিকার হন।
২০০১–২০০৬: বিএনপি-জামায়াত জমানায় ‘টার্গেটেড অ্যাটাক’
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ নেতাদের উপরে ধারাবাহিক হামলা শুরু হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় বহু নেতা নিহত হন, আহত হন শেখ হাসিনাও। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। দল চালাতে হয় আতঙ্কের মধ্যে।
২০০৭–২০০৮: সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ‘মাইনাস টু’ পরিকল্পনা
এই সময় সেনা সমর্থিত ‘নিরপেক্ষ’ সরকার আওয়ামী লিগ ও বিএনপি—দুই দলের প্রধান নেতাকে রাজনীতি থেকে ‘সরিয়ে’ দেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। দল কার্যত নিষ্ক্রিয়। তবে প্রবল জনচাপ ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পান তিনি।
২০২৫: ফের নিষিদ্ধ, শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রিত
এবার ২০২৪ সালের নির্বাচন ঘিরে হিংসা, রাজনৈতিক বিভাজন ও সেনা হস্তক্ষেপের জেরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় বাংলাদেশে। নির্বাচন বাতিল, সংসদ বিলুপ্ত, দলের অফিসে তালা। শেখ হাসিনা বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে রয়েছেন। দলীয় নেতাদের কেউ গ্রেফতার, কেউ আত্মগোপনে রয়েছেন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে এবার?
প্রত্যেকবার নিষিদ্ধ কিংবা দমন হলেও আওয়ামী লিগ ফিরে এসেছে। প্রশ্ন হল—এবারও কি সেই পথ খুলবে? না কি এ বার ইতিহাস নতুন কিছু লেখার দিকে এগোচ্ছে? সময়ই দেবে সেই উত্তর। তবে ইতিহাস বলছে, আওয়ামী লিগের অস্তিত্ব সঙ্কট নতুন নয়, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের শক্তিও এই দলটির অঙ্গ।