
বাংলাদেশ যখন গঠিত হয়, তখন মোট জনসংখ্যার ২০ থেকে ২২% ছিল হিন্দু। সে সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি থেকে ১ কোটি ৫০ লক্ষের আশপাশে। ১৯৭১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫৪ বছরে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে হিন্দু জনসংখ্যার উপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
যদি ১৯৭১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা বিশ্বব্যাপী গড় হারে (প্রতি বছর প্রায় ১.১%) বৃদ্ধি পেত তাহলে ২০২৫ সালে প্রায় ২ কোটি ১৭ লক্ষ হিন্দু সেখানে বাস করত। তবে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে হিন্দু মোট জনসংখ্যার ২২% ছিল, তাদের সংখ্যাই এখন ৮%-এরও কম। এভাবে ৫৪ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা ১৪% হ্রাস পেয়েছে।
২০২২ সালের জনগণনা অনুসারে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অভিবাসনের উপর ভিত্তি করে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আনুমানিক হিন্দু জনসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৫০ লক্ষের মধ্যে পৌঁছতে পারে। এটি বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭.৫ থেকে ৮%।
৫৪ বছরে কমেছে হিন্দু জনসংখ্যা
গত ৫৪ বথরে বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধার অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। শতাংশের নিরিখে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২২% ছিল হিন্দুরা। যা এখন কমে ৭.৫ থেকে ৮% দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনগণনা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। যখন মোট জনসংখ্যার ১৩.৫% ছিল হিন্দু। এই হার ১৯৮১ সালে ১২.১%, ১৯৯১ সালে ১০.৫%, ২০০১ সালে ৯.৩% এবং ২০১১ সালের জনগণনায় ৮.৫%-এ নেমে আসে। এই পরিসংখ্যানগুলি স্পষ্ট ভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
বিপরীতে এই সময়ের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৪ সালে মোট জনসংখ্যার ৮৫.৪% ছিল মুসলিমরাই। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয় ৯১.৫%।
বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কেন কমে গেল?
বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের অনেক ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলির বিশদ বিশ্লেষণ করলে এ দেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং হিন্দুরা এর প্রতিনিয়ত শিকার হয়ে আসছে।
হিন্দুদের অভিবাসন
ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তার আশায় বাংলাদেশ থেকে হিন্দু পরিবারগুলি ভারতে পাড়ি দিয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশান্তরিত হয়েছে। ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে আনুমানিক ৮.১ মিলিয়ন হিন্দু ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। এর অর্থ হল প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ ১৯ হাজার হিন্দু বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর হিন্দুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়েছে এবং তাঁরা অভিবাসনের সুযোগ খুঁজছেন। বাংলাদেশ সেন্টার নামে বাংলাদেশি হিন্দুদের নিয়ে সমীক্ষা চালানো একটি সংস্থা জানিয়েছে, অনেক হিন্দু ভারতে যেতে প্রবল ভাবে আগ্রহী। তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে একটি পরিচিত সাংস্কৃতি এবং নিরাপদ পরিবেশ খুঁজছেন শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার জন্য। অনেক হিন্দু বাংলাদেশির পরিবার এবং আত্মীয় পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বসবাস করে। বিবাহ এবং পারিবারিক সম্পর্কের কারণে অভিবাসনকে একটি স্বাভাবিক পক্রিয়া করে তুলেছেন অনেকেই।
পিউ রিসার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী ১.৬ মিলিয়ন হিন্দু এখন ভারতে বাস করে। এদের মধ্যে অনেকেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে ভারতে এসেছিলেন।
ধর্মীয় নিপীড়ন এবং হিংসা
বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ, মন্দির ভাঙচুর, জমি দখল এবং ধর্ষণ আখছাড় ঘটছে। সম্প্রতি একাধিক অভিযোগ এসেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনার লক্ষ্যবস্তু ছিল হিন্দুরা। স্বাধীনতার পরও ২০০টির বেশি আক্রমণ হয়েছিল। যার মধ্যে ১৯৯০ সালের হিংসা, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী অশান্তি এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতন। এই নিরাপত্তাহীনতার কারণে হিন্দুরা যে কোনও সুযোগে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
হিন্দুদের প্রজনন হারও কম
বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রজনন হার মুসলিমদের তুলনায় কম। ২০১৪ সালে হিন্দুদের প্রজনন হার ছিল ২.১, যেখানে মুসলিমদের ছিল ২.৩। এটিও মুসলিমদের তুলনায় হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধীরগতির অন্যতম একটি কারণ।
বাংলাদেশ সেন্টার সংস্থা ৩ জন গবেষকের রিপোর্ট পর্যালোচনা করেছে। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে হিন্দুদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মুসলিমদের তুলনায় কম ছিল। যার প্রধান কারণ ছিল অভিবাসন, কম প্রজনন হার এবং তুলনামূলক ভাবে উচ্চ মৃত্যুহার।
এই প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মহম্মদ মইনুল ইসলাম বলেন,'জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং গ্রাস ৩টি প্রধান জনসংখ্যাগত প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। জন্মহার, মৃত্যুহার এবং অভিবাসন। এই ৩টি কারণেই হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের কারণ।'