বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে শুরু হয়েছে ‘পদত্যাগ নাটক’। কেন্দ্রবিন্দুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারি পর্যায়ের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে পদত্যাগের ইঙ্গিত দেওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে গুঞ্জন—‘ইউনূস নাটক করছেন’, যে কোনও মুহূর্তে তিনি পদ ছাড়তে পারেন। এই নাটক নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার শেষ নেই। বিএনপি থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি কিংবা গণসংহতি আন্দোলন—প্রায় সব রাজনৈতিক দলই একবাক্যে বলছে, এখন ইউনূসের পদত্যাগ হলে আরও বড় সঙ্কট তৈরি হবে। তাদের বক্তব্য, দেশ এখন সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের রোডম্যাপ চায়, নেতৃত্বে বদল নয়।
হতাশার কারণ নাকি চাপের কৌশল?
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস তাঁর ‘পদত্যাগের চিন্তা’ প্রকাশ করেন। কারণ হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে পক্ষগুলোর অসহযোগিতা, রাজনৈতিক ঐক্যমতের অভাব, রাস্তায় বারবার আন্দোলন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব এবং বিভিন্ন উপদেষ্টার বেফাঁস মন্তব্যকে দায়ী করেন। এসবই তাঁকে ‘হতাশ ও ক্ষুব্ধ’ করে তুলেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের মতে, এটা নিছক হতাশা নয়, বরং কৌশলগত চাপ তৈরি করার চেষ্টা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সরাসরিই বলেছেন, 'আমরা ইউনূস সাহেবের পদত্যাগ চাই না। আমরা চেয়েছি নির্বাচনের রোডম্যাপ। তিনি কেন সেদিকে যাচ্ছেন না, তা বোঝা যাচ্ছে না।'
সেনাপ্রধানের বক্তব্য কি টার্নিং পয়েন্ট?
এর আগে বুধবার সেনানিবাসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য সামনে আসে। তিনি নির্বাচন, জাতীয় নিরাপত্তা এবং ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। এরপর থেকেই ইউনূসের ক্ষোভ বেড়ে যায় বলে জানা যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব এবং অভ্যন্তরীণ উপদেষ্টাদের ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’র পরিবেশেই ইউনূস এই ‘পদত্যাগ নাটক’ সাজিয়েছেন। উদ্দেশ্য—সব পক্ষকে নিজের শর্তে রাজি করানো অথবা ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে সসম্মানে সরে যাওয়া।
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী?
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি—সবাই বলছে, ইউনূসকে পদে রাখতে হবে, তবে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। ইতিমধ্যে বিএনপি ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়েছে এবং শনিবার সন্ধ্যায় সময় পেয়েছে। জামায়াত নেতারাও দেখা করতে যাচ্ছেন। গণসংহতি আন্দোলন ও সিপিবি এক ধাপ এগিয়ে নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করিমসহ অনেকেই বলছেন, এই ‘দাবিদাওয়ার রাজনীতি’ আর চলতে দেওয়া যাবে না। সবাইকে সংলাপে বসে সমাধান খুঁজতে হবে।
ইউনূস যদি সরে যান?
যদি ইউনূস সত্যিই পদত্যাগ করেন, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করছে এনসিপি। দলের নেতারা বলছেন, তাঁকে রাখতে হলে জনগণকেও রাজপথে নামতে হতে পারে। এনসিপি’র মতে, ইউনূসের নেতৃত্বেই জুলাই গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব।
নাটক নাকি বাস্তব সঙ্কেত?
বর্তমানে এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—ইউনূস সত্যিই পদত্যাগ করবেন, না কি এটা চাপ তৈরির একটি অংশ? তাঁর পদত্যাগ মানে হবে পুরো অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোর ইঙ্গিত। কিন্তু তাঁর থাকা মানে হবে, আরও কিছুদিনের মধ্যে পরিষ্কার রোডম্যাপ আসবে—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। দেশ এখন সঙ্কটে, কিন্তু সঙ্কট অদূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে নয়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে সমাধান করতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস ‘নাটক’ করছেন কি না, তা সময়ই বলবে। তবে এই মুহূর্তে তাঁর সরে যাওয়া নয়, বরং দ্রুত সংলাপ ও নির্বাচনের রূপরেখা জাতিকে নির্ভরতা দেবে।