
মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করার পর শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। এই মুহূর্তে তিনি রয়েছে দিল্লির সেফ হাউসে। সেক্ষেত্রে কি ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীকে এবার ঢাকা ফেরানো হবে? আদৌ তাঁর এই মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর হবে?
গত বছর ঢাকার রাস্তা থেকে যে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত পদচ্যুত হন শেখ হাসিনা। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়ে যায়, মুজিবকন্যাকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। সেই থেকেই হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এদিন আন্তর্জাতিক অপকাধ ট্রাইবুনাল তাঁকে মানবতাবিরোধী গুরুতর অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে এবং অবশেষে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায়।
হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে?
ভারতের জন্যও হাসিনার এই সাজা তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের আইনি উপদেষ্টা ভারতের হাতে রায়ের সম্পূর্ণ কপি তুলে দেবেন বলে জানিয়েছেন। একইসঙ্গে হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ফের একবার চিঠি দেবে ঢাকা। এমত অবস্থায় কী করবে নয়াদিল্লি? হাসিনাকে কি ইউনূস সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে না রয়েছে অন্য কোনও বিকল্প?
উল্লেখ্য, হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার দাবি একাধিকবার তুলেছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাঠানো একটি কূটনৈতিক বার্তায় নয়াদিল্লিকে ঢাকা জানায়, তারা সরকারি আইনি প্রক্রিয়ায় হাসিনার প্রত্যর্পণ চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অভিযোগ ছিল, হাসিনাই বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী। তাই তাঁকে ঢাকার হাতে তুলে দেওয়া উচিত।
তবে বাংলাদেশের সেই কূটনৈতিক বার্তায় সাড়া দেয়নি ভারত। এদিকে, হাসিনাকে খুঁজে বের করে এবং ঢাকায় ফেরাতে ইন্টারপোলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে ইউনূস সরকার। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয় তারা।
তবে এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হাসিনাকে রক্ষা করার অর্থ ভারতকে অপরাধে সহায়ক বলে তকমা দেবে ঢাকা।
প্রত্যর্পণ চুক্তি
যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এই সাজা ঘোষণা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ এনেছেন খোদ শেখ হাসিনা। বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়া ন্যয্য ভাবে হয়নি বলেই দাবি তাঁর। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, ভারত এই দাবি জানিয়েই প্রত্যর্পণে অস্বীকার করতে পারে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণের চুক্তি ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে ছিলেন শেখ হাসিনাই।
প্রত্যর্পণের সেই চুক্তি অনুযায়ী, নয়াদিল্লি যদি মনে করে হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার মধ্যে কোনও গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তাহলে তারা প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এই চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, গুরুতর অপরাধের অভিযোগ অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। যেহেতু হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে, যা ট্রাইবুনাল ইতিমধ্যেই সত্য বলে প্রমাণ করেছে এবং সাজা শুনিয়েছে, তাই তাঁর প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করার প্রক্রিয়াটি কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন ঢাকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ইতিমধ্যেই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে।
বিকল্প ব্যবস্থা
তবে আইন থাকলে, আইনের ফাঁকও থাকে। ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে আরও বলা রয়েছে, যদি নয়াদিল্লি মনে করে ঢাকায় ফেরার পর হাসিনার ক্ষেত্রে কোনও বিপদের আশঙ্কা থাকবে অথবা অন্যায্য ব্যবস্থার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে তারা হস্তান্তর করতে অস্বীকারও করতে পারে।
এছাড়াও রয়েছে আরও এক বিকল্প। ভারত-বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তিতে এমন একটি ধারা আছে, যা কোনও পক্ষকে চুক্তি বাতিল করার অনুমতি দেয়। তবে এটি কূটনৈটিক সম্পর্কে দুর্বল করে দেয়। এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া যার জন্য সময় লাগতে পারে। সাজা ঘোষণার সময়ে তাৎক্ষণিক ভাবে তা করা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে, ভারত বর্তমানে রাজনৈতিক শত্রুতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে হাসিনাকে রক্ষা করতে পারে।
তবে হাসিনা কয়েক দশক ধরে ভারতের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন অভিযান এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ভারত তাঁকে হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতিতে ফেরত পাঠাতে এবং দীর্ঘদিনের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না বলেই মত অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের।