করোনায় চলে গেলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা ও মিষ্টি মেয়ে নামে পরিচিত কবরীর মৃত্যুতে গভীর শোকের ছায়া প্রতিবেশী দেশটিতে। শুক্রবার রাত ১২টা ২০ মিনিটে ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে মারা যান কবরী।
গত ৫ই এপ্রিল করোনাভাইরাস পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরে ৮ই এপ্রিল তাঁকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর অবস্থার আরও অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুকালে কবরীর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও মা প্রযোজনা এবং পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। একাধিকবার পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।
২০০৯ সালে তিনি আওয়ামি লিগের মনোনয়নে নারায়ণগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জগতে জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সেদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা। এর বাইরেও মধ্যরাতে কবরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক হয়ে ওঠে বিষাদময়।
বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হবে বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে সারাহ বেগম কবরীকে। শনিবার বাদ জোহর কবরস্থান এলাকায় তাঁর জানাজা হবে। জানাজা শুরুর আগে বনানী কবরস্থানের সামনেই মুক্তিযোদ্ধা এই অভিনয়শিল্পীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে।
১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় কবরীর। ১৯৬৫ সালে অভিনয় করেন ‘জলছবি’ ও ‘বাহানা’য়, ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’। ১৯৭০ সালে ‘দীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বিনিময়’ তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান কবরী। সেখান থেকে যান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে ‘রংবাজ’ পায় বেশ জনপ্রিয়তা। ১৯৭৫ সালে নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’ ছাড়িয়ে যায় আগের সব জনপ্রিয়তাকে। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা সামনের দিকে। জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আগন্তুক’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’। ৫০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী।
২০০৫ সালে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কবরী। এমনকি ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। এরপর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন কবরী। তাঁর আসল নাম ছিল মিনা পাল। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও সবশেষে সিনেমায়। কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা।