
ইতিমধ্যেই ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের তিনটি ভিসা কেন্দ্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা। এবার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে ফের তলব করল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। মঙ্গলবার সকালে তাঁকে ঢাকার বিদেশ মন্ত্রকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বরও তাঁকে তলব করা হয়েছিল। সূত্রের খবর, প্রণয় ভার্মাকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ নিয়ে গত ১০ দিনে প্রণয় ভার্মাকে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক তলব করল। প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিভিন্ন ঘটনায় এ নিয়ে অন্তত ছয়বার তলব করা হলো ভারতীয় হাইকমিশনারকে।
প্রসঙ্গত কয়েক দিন ধরেই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে টানাপড়েন বাড়ছে। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে প্রথমে ভারত বাংলাদেশে তাদের একাধিক ভিসা আবেদন কেন্দ্র (রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম) বন্ধ করে দেয়। এর পাল্টা হিসেবে সোমবার রাতারাতি দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশের ভিসা কেন্দ্র সহ শিলিগুড়ি ও আগরতলার কেন্দ্রগুলিও বন্ধ করে দেয় ঢাকা। এই ‘ভিসা যুদ্ধের’ আবহে মঙ্গলবার সকালে পুনরায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করায় দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। মূলত ময়মনসিংহে হিন্দু যুবক দীপু দাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ হয়। ভারত সরকার সেই বিক্ষোভকে ‘অতিরঞ্জিত’ না করার আবেদন জানালেও, ইউনূস প্রশাসন দিল্লির অবস্থানকে ‘সরলীকরণ’ হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী মন্তব্য এবং ভারতীয় কূটনৈতিক দফতরগুলির নিরাপত্তা নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক এই গতিপ্রকৃতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক অস্থির সময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশি হাইকমিশনের বাইরে উত্তেজনা
বাংলাদেশে দীপু দাস খুনের প্রতিবাদে মঙ্গলবারও দিল্লির বাংলাদেশি হাইকমিশনের বাইরে উত্তেজনা ছড়াল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বজরং দল এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠনের কর্মীরা বাংলাদেশ হাইকমিশনের বাইরে তীব্র প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ব্যানার এবং পোস্টার হাতে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তার দাবি জানান।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী একজন কর্মী বলেন, 'বাংলাদেশে হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে, এই নৃশংসতা আর সহ্য করা যাবে না।' এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে দিল্লি পুলিশও সতর্ক অবস্থায় ছিল। হাইকমিশনের বাইরে তিন স্তরের ব্যারিকেড তৈরি করা হয় এবং পুলিশের পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। রাস্তার দুই পাশে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে এবং পুরো এলাকা সিসিটিভি নজরদারির আওতায় রয়েছে।
কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ
ইতিমধ্যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতে অবস্থিত তার কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নয়াদিল্লি এবং শিলিগুড়ির ঘটনা নিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেকোনও হিংসা বা হুমকি অগ্রহণযোগ্য এবং শান্তি, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার নীতিকে ক্ষুণ্ন করে।'
বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের নিরাপত্তা জোরদার
এদিকে, হিংসা ও বিক্ষোভের পর ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দূতাবাসের চারপাশে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশি সেনাবাহিনী সাঁজোয়া যান নিয়ে মূল গেটে উপস্থিত রয়েছে। রাজশাহী ও চট্টগ্রামের মতো এলাকায়ও ব্যাপক বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। দীপু দাসের হত্যার পর থেকে, এই বিষয়টি কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং একটি সংবেদনশীল কূটনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে।
মার্কিন সাংসদদের প্রতিক্রিয়া
এদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, সংবাদমাধ্যমের উপর হামলা এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দুই প্রভাবশালী মার্কিন আইনপ্রণেতা। পাশাপাশি সাংসদরা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হিংসা ও অস্থিরতার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ।
ভারতীয়-আমেরিকান আইন প্রণেতা রাজা কৃষ্ণমূর্তি এবং সুহাস সুব্রহ্মণ্যম পৃথক বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছেন যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর আলোকে এই হিংসা বিপজ্জনক অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। তাঁরা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা, হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ তদন্ত এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা প্রতিরোধের পরিকল্পনা দাবি করেছেন।
দীপু চন্দ্র দাসের হত্যার নিন্দা
কৃষ্ণমূর্তি হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসের হত্যার তীব্র নিন্দা করে বলেন, এটি বাংলাদেশে অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। তিনি বলেন, যদিও কর্তৃপক্ষ কিছু গ্রেফতার করেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে বিষয়টির তদন্ত করা এবং দায়িদের কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করা। সুব্রহ্মণ্যম তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন যে দীপু দাসের হত্যা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনির এক ভয়াবহ প্রবণতা প্রতিফলিত করে। তিনি বলেন, 'কারখানার শ্রমিক দীপু দাসের হত্যাকাণ্ডে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। এই ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য এবং বেদনাদায়ক এবং এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা উচিত।' তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ বেড়েছে এবং বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশে দীপু দাস খুনের প্রতিবাদে দিল্লির বাংলাদেশি হাইকমিশনের বাইরে উত্তেজনা ছড়াল। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে হাইকমিশনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করার অভিযোগ উঠেছে।