কলকাতার রাস্তায় মাঝরাতে হিট অ্যান্ড রান। গুরুতর আহত কলকাতা পুলিশের এসআই। তদন্তে নামে পুলিশ। ধরা পড়ে অভিযুক্ত— ৪১ বছরের আজাদ শেখ। কিন্তু ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে, যখন জানা যায়, আজাদ আদপে একজন বাংলাদেশি। বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে সে কলকাতায় বসবাস করছিল। শুধু আজাদ নয়, গত কয়েক মাসে এমন অসংখ্য অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিক ধরা পড়েছেন দেশের নানা প্রান্তে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে রাজস্থানের জয়পুরে পুলিশ ৫০০ জন বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে। এপ্রিল মাসে গুজরাতের আহমেদাবাদ ও সুরাতে ধরা পড়ে ১,০০০-রও বেশি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা এবং মালদা, এই জেলাগুলিতে তো এমন অনুপ্রবেশ রীতিমতো উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে।
প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও হস্তক্ষেপ করতে পারে
ভারতের তরফে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যাপক ধরপাকড়ের মাঝেই, সীমান্ত ঘিরে উত্তপ্ত হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। সোমবার বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়ে দিলেন, ভারত যদি কোনওভাবেই জোর করে অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশে ঢোকানোর চেষ্টা করে, তা কখনও মেনে নেওয়া হবে না। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক অপারেশন দপ্তরের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন,
“ভারতের তরফে যেভাবে বৈধ নথি ছাড়া মানুষদের আমাদের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, সেটা অগ্রহণযোগ্য। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি পরিস্থিতি সামলাচ্ছে ঠিকঠাক, কিন্তু প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তুত।”
গত কয়েক মাস ধরেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ধরা পড়ছে হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী। এদের অনেককেই সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে বিজিবি-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের গ্রহণ করতে নারাজ। ফলে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ বাড়ছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৬ সালের ভারত সরকারের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ২ কোটির বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছেন। এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
কাঁটাতার থাকার পরেও কীভাবে ঢুকছে?
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪,০৯৬.৭ কিমি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩,২৩২ কিমি সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাকি অংশ এখনও উন্মুক্ত। অনেক জায়গায় নদী, দ্বীপ, গ্রাম, এনক্লেভ ইত্যাদির কারণে কাঁটাতার বসানোই যাচ্ছে না। ফলে অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকছে। অনেক সময় রাতের অন্ধকারে নদীপথ বা অরক্ষিত বনাঞ্চলের ফাঁক গলে বাংলাদেশ থেকে ঢুকে পড়ছেন মানুষজন। অনেক সময়ে আবার বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে চোরাপথে ঢুকিয়ে দিচ্ছে পাচারকারীরা। তার উপর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) অনেক সময় ভারতের পক্ষকে সীমান্তে কাঁটাতার বসাতে বাধা দেয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেই বিএসএফ ও বিজিবি-র মধ্যে এই নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। এমনকী ১৯৭৫ সালের এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে, যা সীমান্তে স্থায়ী কাঁটাতার বসাতে ভারতকে কিছুটা আটকে দেয়।
ডিপোর্টেশন কি এত কঠিন?
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০২৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অসম সরকারকে নির্দেশ দেয়— যাঁদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানো হোক। কিন্তু বাস্তব বলছে, কাজটা মোটেই সহজ নয়। অনেক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নিজেদের পরিচয় গোপন রাখেন, অথবা ভুয়ো পরিচয়পত্র বানিয়ে ফেলেন। তাছাড়া, যতজনকে ধরা হচ্ছে, তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কোনও কূটনৈতিক বা কার্যকরী বন্দোবস্ত এখনও নেই। বাংলাদেশও অনেক সময় অনুপ্রবেশকারীদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করতে চায় না। ফলে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের দাঙ্গা ও ভোট-রাজনীতি
মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদের একাধিক জায়গায় যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়েছিল, তার পেছনেও অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি করছে একাংশ। এই সব অঞ্চলে ভিনদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা এতটাই বেশি যে, স্থানীয় জনসংখ্যার ভারসাম্যই বদলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। তবে এর সঙ্গে রাজনীতির যোগও অস্বীকার করা যায় না। বহু অনুপ্রবেশকারী ভোটার কার্ড বানিয়ে ভোট দেন। রাজনৈতিক দলগুলিও তাঁদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। এর ফলে সরকার কোনও কড়া পদক্ষেপ নিতে দ্বিধায় পড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু সীমান্তে কাঁটাতার বসালেই হবে না। প্রয়োজন স্থানীয় স্তরে নজরদারি বাড়ানো, আধার ও ভোটার আইডির জালিয়াতি রোখা, এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। এছাড়াও, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে এগোনো দরকার। কূটনৈতিক স্তরে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে হবে, যাতে তারা নিজের দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়।