পথের পাঁচালী(Pather Panchali)- বাংলা তথা ভারতীয় চলচিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে যে। একদিকে তাঁর মুখ্য চরিত্র অপু (Apu), অন্যদিকে দারিদ্র্যে মোড়া একটি আস্ত পরিবার। ১৯২৯ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই উপন্যাস তৎকালীন সময় কলকাতার একটি পত্রিকায় একাধিক পর্বে ছাপা হয়। যদিও, সেই সময় পাঠকদের তা তেমন ভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি। পরবর্তী সময়, ১৯৫৫ সালে সত্যতিৎ রায়ের(Satyajit Ray) হাত ধরে পথের পাঁচালী সেলুলয়েডে আসতেই তা যেন বিভূতিভূষণের লেখাকে জীবন্ত করে তোলে। সাধারণত বলা হয়, একটি উপন্যাসকে কেন্দ্র করে কোনও ছবি তৈরি হলে তা কিছুটা আসল লেখা থেকে বিচ্যূতি ঘটে। হয়তো ছবির সময়ের কারণেই তা ঘটানো হয়ে থাকে। কিন্তু পথের পাঁচালীর ক্ষেত্রে তা ছিল একেবারেই ব্যাতিক্রমী। এখানে লেখনির ভাষা যতটা শক্তিশালী ছিল, তার থেকে ঢের বেশি ছিল সিনেমার ভাব প্রকাশ। তাই হয়তো এই ছবিকে নিয়ে দেশ বিদেশে এতো আলোচনা, এতো মাতামাতি।
যাই হোক পথের পাঁচালীর অনেক জানা তথ্য নিয়েই অনেক "প্যাঁচাল পাড়া" হল, এবার আসি আসল কথায়। এই সিনেমায় রায় পরিবারের মূলত ২টি চরিত্রই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকে। এক অপু ওরফে অপূর্ব রায় এবং তার দিদি দূর্গা(Durga)। কিন্তু এই সিনেমায় অপর তিনটি মুখ্য চরিত্র অপু-দূর্গার বাবা হরিহর রায়, তাদের এক ঠাকুমা ইন্দির ঠাকরণ এবার তাদের মা সর্বজয়ার(Sarbajaya) চরিত্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদিও, অপু-দূর্গার লাইমলাইটের কাছে তাঁদের চরিত্র সিনেমা প্রেমীদের মনে অপেক্ষাকৃত কম জায়গা করেছে।
কিন্তু, কে ছিলেন সত্যজিতের এই সর্বজয়া? কোথা থেকেই বা তিনি এসেছিলেন? কীভাবেই বা ফুঁটিয়ে তুলেছিলেন অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু দৃঢ়চেতা এক গ্রামীণ গৃহবধূর চরিত্র?
শোনা যায়, ছবিটি করার সময়, অপু ও দূর্গার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন এমন এক অভিনেতাকে খুঁজছেন সত্যজিৎ। কোথাও কোনও উপায় না দেখে একটি হাজির হন বন্ধু সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেখানেই সুব্রতবাবুর স্ত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়ে বসেন পরিচালক। শুরুতে সরাসরি 'না' শুনে ফিরে আসতে হয় সত্যজিৎকে। যদিও, পরবর্তী সময়ে সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জোরাজরিতে সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হন তিনি। শোনা যায়, নিজের জীবনের অনেকটা অংশজুড়ে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সঙ্গে, পরিবারের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিতে অনেকটা লড়াই করতে হয় তাঁকে। সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে ছবিতে সর্বজয়ার চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন করুণাদেবী। গ্রামের অত্যন্ত সাধারণ এই গৃহবধূ কিন্তু আসল জীবণে ছিলেন নিষিদ্ধ বামপন্থী দলের সক্রিয় সদস্যা। তাঁর লেখনি, নাটকের অভিনয় সবই ছিল প্রথমে ব্রিটিশ রাজশক্তি ও পরে সৈরাচারী জোতদার-মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। অনেক সময়ই তাঁকে পুলিশি অভিযানের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।
মধ্যপ্রদেশের বৈকুষ্ঠপুরে এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল করুণাদেবীর। সেখান থেকে দারিদ্রের তাড়নায় কলকাতায় চলে আসতে হয় তাঁর পরিবারকে। দুই দাদা ও মায়ের কাছেই লেখাপড়ার শুরু তাঁর। এরপর স্কুলের গণ্ডি পাড় করে কলকাতার যোগমায়া দেবী কলেজে স্নাতক। পরবর্তী সময় কিছুটা জোর করেই দারিদ্রের করাল গ্রাস থেকে নিজের ধ্যান সরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে স্নাতোকত্তর ডিগ্রা পান তিনি। সেখানেই করুণাদেবীর সঙ্গে পরিচয় হয় সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বামপন্থী নেতা সুব্রতবাবুর সানিধ্যে আসতেই, তাঁরও প্রতিবাদী মন সেই সংগঠের প্রতি আকৃষ্ট হয়। দু'জনে মিলেই শুরু করেন সাধারণ মানুষেক কথা বলা। সেই সঙ্গে, তৎকালীন সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও গর্জে ওঠে তাঁদের দল। এদিকে, সংগঠনের কাজের ফাঁকেই সুব্রতবাবুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যদিও, এই কাজে সায় ছিল না দুই পরিবারেরই। কিছুটা জোর করেই বিয়ে সম্পন্ন হয় তাঁদের। বাংলায় ৪২-শের মন্নতর, শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব থেকে দারিদ্র- সবটাই তাঁর মনকে প্রবল ভাবে নাড়া দেয়। আর সেখান থেকেই অভিনয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলতেন তিনি।
মনে করা হয়, সেই জয়গা থেকেই সর্বজয়ার চরিত্র ফুঁটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। একদিকে সাধারণ গ্রাম্য বধূ, অন্যদিকে সন্তানদের মানুষ করতে অত্যন্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মেয়ে দূর্গা ঠাকুমা ইন্দির ঠাকরণের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হওয়ায়, সেখানেও কিছুটা মনের মধ্যে ঈর্ষা। এই প্রতিটি বিষয়ই নিজের চরিত্রে ফুঁটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। আর এখানেই হয়তো, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সর্বজয়া হয়েই দর্শক মননে থেকে গেছেন এই নারী চরিত্র।
সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে অপু, দূর্গা থেকে আগন্তুক- সব নিয়েই হয়তো আলোচনা হচ্ছে, হবেও, কিন্তু, সর্বজয়া যে কালজয়ী একজন নারী চরিত্র তা হয়তো অনেকেই ভুলে যান। যেমনটা অনেক ফিল্ম ক্রিটিও করে থাকেন।
সাধারণ ভাবে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে, যে নারী চরিত্রগুলিকে দেখানো হয়েছে তাঁরা মূলত এমন একটা সময়ের প্রতিনিধি যেখানে তাঁদের পুরুষতান্ত্রীক সমাজ ব্যবস্থায় দমিয়ে রাখা হত। সমাজ ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, কোনও ক্ষেত্রেই সেই সময়ের নারীদের কথা বলার অধিকার ছিল না, প্রতিবাদ করা তো দূর। আর সেখানেই ভিন্ন মত নিজের ছবির মাধ্যমে পোষণ করে এসেছেন সত্যজিৎ। তাঁর তৈরি প্রতিটি ছবিতেই, নারীদের প্রথাগত ব্যবস্থা থেকে তুলে এনে প্রতিবাদী করে তুলেছেন। পথের পাঁচালীর সর্বজয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। আর তাই বোধহয়, অমন এক মানুষকেই এই চরিত্রের জন্য বেছে নিয়েছিলেন জুহুরি সত্যজিৎ!