পুরাতন
পরিচালক: সুমন ঘোষ
অভিনয়: শর্মিলা ঠাকুর, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
রেটিং: ৪/৫
সিনেমার নামের মধ্যেই লুকিয়ে গোটা একটা কাহিনি। আর এই গল্পকে যিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে গিয়েছেন তিনি হলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়ের সেই দেবী আবার সুমন ঘোষেক পরিচালনায় ফিরলেন বাঙালির আবেগ হয়ে, মুগ্ধতা হয়ে। পরিচালক সুমন ঘোষের পুরাতন গল্প বলবে এক শিকড়ের, যা জড়িয়ে থাকে গঙ্গার পার ঘেঁষা পুরনো বাড়ির শ্যাওলা ধরা ইটের পাঁজরে। পরিচালকের এই সিনেমায় এক বৃদ্ধা (শর্মিলা ঠাকুর), যিনি তাঁর হারিয়ে যাওয়া সময়কে সমসাময়িক করে রেখেছেন নিজের কাছে।
এই ছবির মধ্যমণি শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্র। তাঁকে আবর্ত করেই গড়ে উঠেছে অন্য চরিত্রগুলি। শর্মিলা ঠাকুরের মেয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (ঋতিকা) ও তাঁর প্রেমিক ইন্দ্রনীল (রাজীব) যখন তাঁদের মায়ের ৮০তম জন্মদিন উদযাপন করতে একত্রিত হন, তখন বুঝতে পারেন যে শর্মিলা ঠাকুরের স্মৃতিশক্তি ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। ভুলে যাওয়ার চেয়েও বেশি, তাঁর অতীত-বর্তমান মিলেমিশে একাকার, যা বেশ উদ্বেগজনক। সুমন ঘোষের ছবিটি গল্পের উপর বেশি নির্ভর করে না, বরং তিনি কীভাবে এটি উপস্থাপন করতে চান তা নিয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এখানে একটি সূক্ষ্ম সংযমের সঙ্গে গল্পটিকে বলা হয়েছে, দর্শকদের স্মৃতিচারণ এবং আকাঙ্ক্ষার যন্ত্রণা, আনন্দের মুহূর্ত এবং অস্থির স্মৃতির অনুভূতি দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের একটি বাক্স দেখানো হয়েছে, সুন্দর কারুকার্য করা কাঠের বাক্স। যেখানে জমানো রয়েছে পুরনো পাসবই, দুর্গাপুজোর বিল, মুদিখানার তালিকা সহ আরও অনেক পুরনো জিনিস, যা অনেক বাঙালি বাড়িতে খুঁজলে হয়তো আজও পাওয়া যাবে। এগুলো না ধরে রাখতে পারছেন আর না এগুলো নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছেন। আসলে পুরাতন ছবিটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো জিনিসের প্রতি মোহ আমাদের যেন অজান্তেই বেড়ে যায়। সেগুলো নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই।
বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে চাকুরিরতা ঋতিকা তাঁর মায়ের আদরের মামনি। মায়ের স্মৃতিবিভ্রান্তি কন্যাসন্তানকে উদ্বিগ্ন করে। অগোছালো হয়ে যায় তাঁর জীবন। ভালবাসার মানুষ, পেশায় ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সে। সেই ভালবাসার মানুষের মন আবার তার পূর্বতন মৃতা স্ত্রীর স্মৃতিসহবাসে আটকে। মা আর প্রেম, সম্পর্কের দু’জায়গায় সংশয় নিয়ে লড়াই করে চলে ঋতুপর্ণার চরিত্র। মনের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্ব, সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছে, তাঁর বিভিন্ন অভিব্যক্তি ঋতুপর্ণা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন নায়িকা।
পুরনো আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটে একান্ত স্মৃতির উপকরণগুলোকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, মায়ের জন্মদিনে মাকে সে সব ফিরিয়ে দিয়ে যে আবেগঘন মুহূর্ত নির্মাণ করেছেন তিনি তা এক কথায় অনবদ্য। যে মুহূর্তে তিনি অস্ফুটে বলে ওঠেন ‘মা ওয়াজ় নেভার আ উওম্যান উইথ মিস্ট্রিজ’... তখনই মা-মেয়ের অন্তরের সম্পর্কে কোথাও চিড় ধরে। মাকে ঠিক বুঝতে পেরেছে তো মেয়ে? এই ছবির মাধ্যমেই বাংলা ছবিতে কামব্যাক শর্মিলা ঠাকুরের। সিনেমায় তাঁর প্রতিটি স্তরের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তিনি তাঁর চরিত্রের সঙ্গে যথেষ্ট ন্যায় করেছেন। তাঁর নীরবতা যে কোনও সংলাপের চেয়ে আবেগপ্রবণ। শর্মিলার চরিত্র মাঝে মধ্যেই ছবিতে এমন এক নীরবতার সৃষ্টি করে যা দর্শককে ভাবতে, থামতে ও শুনতে বাধ্য করে।
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত তাঁর চরিত্রে যথাযথ ছিলেন। তিনি ভূমিকার প্রতি ন্যায়বিচার করেন এবং একই ফ্রেমে থাকা সত্ত্বেও নিজের অবস্থান ধরে রাখেন। পুরাতন ছবিটি একটি পুরনো কাঠের বাক্সকে ঘিরেই বলা চলে। অনেক না-বলা কথা, ঘটনা তার মধ্যে লুকিয়ে আছে। যাদের জীবনে তাড়হুড়ো আছে তাদের জন্য পুরাতন নয়। এখানে কোনও সিনেমাটোগ্রাফির দারুণ কিছু দেখানোর নেই। কিন্তু যদি মন দিয়ে এই ছবিটি দেখেন, তাহলে পুরাতন কথা বলবে আপনাকে, আমাকে নিয়ে, আমাদের দিদা-ঠাকুমারা অথবা বৃদ্ধা মায়েরা যেসব আবেগকে নিয়ে বেঁচে থাকেন, যাঁদের কাছে এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরনো স্মৃতি, সেইসব পুরনো কাগজপত্র, ছবি নিয়ে। পুরাতন ছবিতে কোনও অনাবশ্যক নাটক নেই, কোনও রোলারকোস্টারে চেপে অতীতে ফিরে যাওয়ার তাড়া নেই। কিন্তু যদি আপনি আপনার পুরনো ডায়েরির মতোই সিনেমাকে ভালোবাসেন...নিজের পুরনো স্মৃতিকে রোমন্থন করতে চান, তাহলে পুরাতন ছবিটি আপনার জন্য। যা দেখার পর আপনার মনে হবে না সময় নষ্ট হল।