মন খারাপ তিনধারিয়া-গয়াবাড়ির
তিনধারিয়া(Tindharia)-গয়াবাড়ি(Gayabari)-সেলিম হিল চা বাগান(Selim Hill Tea Estate) এলাকার বাসিন্দাদের বুধবার সকাল থেকেই মন খারাপ। তাঁদের হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা দিলীপ সাব(Dilip Kumar) আর নেই। পঞ্চাশ বছর আগের কয়েক মাস এই এলাকার আনাচে কানাচে যেভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সাগিনা মাহাতো (Sagina Mahato), তা যেন চোখ বুজলেই দেখতে পান আট থেকে আশি। না অবাক হওয়ার কিছু নেই। যাঁরা নিজের চোখে দিলীপ কুমার-সায়রা বানু-অনিল চট্টোপাধ্য়ায়দের শুটিং করতে দেখেছেন তাঁরা তো বটেই, বাকি যাঁরা তখন জন্মাননি তাঁরাও ছোট থেকে বাবা, মায়ের কাছে তাড়িয়ে তাড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন এতবার শুনেছেন, যেন তাঁদেরও চোখের সামনে ছুটে বেড়িয়েছেন সিনেমার কুশিলবরা।
চোখে বুঝলেই "ছোটি ছোটি সপ্না হামার"
বিশেষ করে যখন তিনধারিয়ার রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, কিংবা ইলা পালচৌধুরীদের বাড়ি, টয়ট্রেনের লাইনের সামনে অলস দাঁড়িয়ে থাকেন কিংবা ঘুরে বেড়ান এলাকার বাসিন্দারা তখন যেন তাঁরা আরও বেশি করে সে সব হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য দেখতে পান। এর মধ্যে অনেকে বাপ-ঠাকুরদার কাছে শুনে সিনেমাটি দেখেছেন অনেকবার। সাদা কালো ছবি হলেও নিজেদের এলাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে কোনও অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে টয়ট্রেনকে ব্যাকড্রপে রেখে দিলীপ-সায়রার নাচ আর অনুপ ঘোষালের "কণ্ঠে ছোটি সি পন্ছি.......ছোটি ছোটি সপ্না হামার" শুনতে পান, মন চলে যায় ৫০ বছর আগে।
সবার চেয়ে আলাদা 'সাগিনা মাহাতো'
দার্জিলিং পাহাড়ের আনাচে কানাচে কিংবা চা বাগানের সৌন্দর্যকে আঁকড়ে ধরে অতীত-বর্তমানে অনেক ছবি হয়েছে। সে রাজেশ খান্না-শর্মিলা ঠাকুরের(Rajesh Khanna) আরাধনা(Aradhana) থেকে শাহরুখ খান-সুস্মিতা সেনের ম্যায় হুঁ না, কিংবা রণবীর কাপুর-প্রিয়ঙ্কা চোপড়া-ইলিয়ানা ডিক্রুজের বরফি। কিংবা অমিতাভ বচ্চন-রাখির অনুসন্ধান কিংবা সঈফ আলি খান-বিদ্যা বালানের পরিণীতা। বাংলা ছবি যে কত হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। তবে বাকি সব ছবিই সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপটে তৈরি। দিলীপ কুমার-সায়রা বানু অভিনীত সাগিনা মাহাতো সবচেয়ে আলাদা।কারণ স্থানীয় রাজনীতিকে প্রেক্ষাপট করে আর কোনও ছবি হয়নি। আগেও না, পরেও না। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছিল গল্পে। ফলে দার্জিলিং পাহাড়ের ফিল্ম আর্কাইভে সাগিনা মাহাতো একদম স্বতন্ত্র পাড়ার বাসিন্দা। আর সেই সময়ের বলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নেওয়া নায়ক দিলীপ কুমার যে পারিশ্রমিকের কথা না ভেবে শুধুমাত্র স্ক্রিপ্ট আর পরিচালককে দেখে রাজি হয়ে যাবেন সেটাও তখনও কেউ ভাবতে পারেননি।
ঘাঁটি গেড়েছিলেন একগুচ্ছ অভিনেতা
গৌর কিশোর ঘোষের বহুল চর্চিত সাগিনা মাহাতো আসলে একটি ছোট গল্প। সেটিকে চিত্রনাট্যে পরিণত করেন পরিচালক তপন সিংহ। তিনি গল্পটাকে একটু পাল্টে দেন। আসল গল্পের সাগিনার দেহ, শিলিগুড়ি লাগোয়া সুকনায় টয়ট্রেনের লাইনের উপর উপুর হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু ছবিতে তপন সিংহ সাগিনাকে নয়, ছবির ক্লাইম্যাক্সে খুন করে দেন বিজন দত্তকে। ছবিতে অবশ্য গল্পের বিজনের নাম বদলে দিয়ে করা হয় অনিরুদ্ধ। খুনি তারই কমরেড। দিলীপ-সায়রা ছাড়াও এ ছবিতে ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, সুমিতা সান্যাল, স্বরূপ দত্ত, চিন্ময় রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রথিতযশারা।
সাগিনাতেই পৃথক পরিচিতি তিনধারিয়ার
এহেন এত বড় একটা কর্মযজ্ঞ যা এলাকার অর্থনীতিকে তখনকার মতো বদলে দিয়েছিল। জাতীয় চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এলাকাটিকে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। সেই ছবি তো এলাকার বাসিন্দাদের মনের মণিকোঠায় থাকবেই। তাছাড়া ৫০ বছর আগে দিলীপ সাবের মতো বড় তারকা তখন বিনোদন জগতে ছিল হাতেগোনা। মূল কারখানাটি অবশ্য ধসে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেটিকে মেরামত করে সংষ্কার করা হলেও এই কারখানায় সেই ছোঁয়া নেই। তাছাড়া এখন আর কারখানার কাজ হয়না। তবু জায়গাটিতো আছেই। তাই বা কম কিসে?
অতীতের স্মৃতির দলিল এখন পরিত্যক্ত রেল ওয়ার্কশপ
কারখানা এলাকাতেও অবশ্য পুরনো কেউই নেই। তবে অতীতের ছায়ারা কেউ কেউ আছেন। যেমন তিনধারিয়া হাইস্কুলের এক প্রাক্তন শিক্ষক এখনও চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পান কারখানার ভিতর ফোরম্যানকে বেধড়ক মারছেন। একবারে সন্তুষ্ট নন পরিচালক। বারবার শুটিং হচ্ছে। শেষমেষ ক্ষান্ত দিলেন তপনবাবু। কারও কারও মনে আছে, শট শেষ করে দিলীপকুমার একটা চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন।
দিলীপ সাব যেন অস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন
বাংলা এবং হিন্দি দুবার ছবির শুটিং হয়েছে একই জায়গায়। দুবারই ইউনিটের প্রায় সকলেই ছিলেন গয়াবাড়িতে ইলা পালচৌধুরীদের বাড়িতে। এখনও সেই বাড়ি রয়েছে। দিলীপ-সায়রাদের স্নানের জন্য গরম জল বাথরুমে পাঠানো হতো বয়লারে কাঠকয়লা পুড়িয়ে পাইপের মাধ্যমে। কারণ তখনও গিজার ছিল না বলে জানা গিয়েছে। গয়াবাড়িতে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন দিলীপ-সায়রা। অতবড়স তারকাদের হাতের কাছে পেয়ে অটোগ্রাফ, সই তো বটেই, মাঝে মধ্যে শুটিংয়ের গল্প শুনতেও অনেকে আসতো। আবার স্থানীয় স্কুলের সংস্কারে অর্থ দানও করেছিলেন দিলীপ। বেশ কিছু স্কুলে ফাংশানে হাজির হতে হতো তাঁদের। এ সব গল্প এক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছিলেন সাকিলা গুরুং। ওই ছবিতে কয়েকটি দৃশ্যে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করা মনোহর প্রধান এবং কল্যাণ ছেত্রীরা এখনও আছেন। তাঁদের ভাল মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু সিনেমাটি এতবার দেখেছেন, যেন মনে হয় সব এখনও দেখছেন। দেখেই যাচ্ছেন।
জলসা বসত পালচৌধুরীদের বাড়িতে
পালচৌধুরীদের বাড়িতে শুটিং সেরে ফিরে জলসা বসত রোজ। তেলেভাজা-পকোড়া ভাজা হতো। আবৃত্তি, গান, অভিনয়, ক্যারিকেচার নিয়ে জমে উঠত এক একটা সন্ধ্যা। বাড়ির পিছনের লনে ক্রিকেট খেলা হতো। তাতে সক্রিয় অংশ নিতেন দিলীপকুমার। তবে তাঁর ব্যাটে যতটা আগ্রহ ছিল, বল বা ফিল্ডিংয়ের নয়। এসবই টুকরো টুকরো মনে আছে কারও কারও। তখন দার্জিলিংয়ের কনভেন্ট স্কুলেই পড়তেন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে অরূপ। তিনিও বাবার ছবির শুটিং হবে বলে ঘাঁটি গেড়েছিলেন শুটিং দলের সঙ্গে।
স্মৃতি এখন ইতিহাস
এসবই বুধবার থেকে শুধু স্মৃতি নয়, ইতিহাস। যে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও টিঁকে গুটিকয় পাহাড়ি প্রবীণ ও দিলীপসাবের ছায়াসঙ্গী সায়রা বানু।