সময়টা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশক। কলকাতার এক বাঙালি ঘরের সন্তান হঠাৎই রপ্ত করে ফেললেন পশ্চিমী আদপ-কায়দা। লম্বা চুল, পিঠে গিটার, মুখে ইংরেজি গান। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুদের নিয়ে গড়ে ফেললেন ব্যান্ড। কলকাতার অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় শুরু করলেন পারফর্ম। অন্যদিকে আবার সেই মানুষটাই জড়িয়ে পড়লেন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে। গান আর আন্দোলন চলতে থাকলো একইসঙ্গে। যদিও খুব বেশিদিন তা টানা যায়নি। কারণ রাজনৈতিক আদর্শের চোখে বিচার করে একসময় ইংরেজি ব্যান্ড ছেড়ে নিজেই বেড়িয়ে যান তিনি। আর গ্রেফতার হওয়ার পর ভাটা পড়ে রাজনীতিতে। তবে জেলবন্দি হলেও সবসময়ই তাঁর অন্তরে বেঁচে ছিল এক শিল্পী সত্ত্বা। কারণ তিনি যে গৌতম চট্টোপাধ্যায়। আর তখনও যে তাঁর 'কতো কী করার আছে বাকি'।
যেতে হয়েছিল ভিনরাজ্যে
শোনা যায় জেলে বসে অসংখ্যা গান লিখেছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। প্রায় দেড় বছর পর জেল থেকে মুক্তি পান। তবে শর্ত ছিল একটাই, পশ্চিমবঙ্গের ধারেকাছেও যেন তাঁকে দেখা না যায়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ভোপালে চলে যান গৌতম। সঙ্গী একটা স্প্যানিশ গিটার। সেখানে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি নেন। তার কিছুদিন পর যান জব্বলপুর। আর চাকরির পাশাপাশি লিখে চললেন গান। বলতে গেলে আগামিদিনের সঙ্গীত জগতে যে বিপ্লব ঘটতে চলেছে,তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল ভিনরাজ্যে বসেই।
মহীনের ঘোড়াগুলির যাত্রাশুরু
প্রবাসে অবশ্য বেশিদিন মন টেকেনি গৌতমের। চাকরি ছেড়ে ফিরলেন কলকাতায়। ভাই ও বন্ধুদের নিয়ে পূর্ণ উদ্যোমে নতুন করে শুরু হল গান বাজনা। দিনরাত বাড়িতে চলতো গানের রিহার্সাল-প্র্যাকটিস। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠানও শুরু করলেন তাঁরা। কিন্তু তখনও দলের কোনও নির্দিষ্ট নাম নেই। এরপর একদিন কোনও এক আড্ডায় দলের সদস্য রঞ্জন ঘোষাল প্রস্তাব দেন দলের নতুন নাম 'মহীনের ঘোড়াগুলি'। তারপর থেকে সেই নামটি আর পরিবর্তন হয়নি। এই দলই বাংলা সঙ্গীতের জমিতে ব্যান্ড মিউজিকের বীজ পুঁতে দিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময় মহীনের ঘোড়াগুলি ভাঙে, আবার গড়ে। অ্যালবাম রিলিজ হয়। নতুন প্রজন্মের বুকে গৌতমের মহীনের ঘোড়াগুলির গান ভরে দেয় মুক্ত বাতাস।
ছবির গৌতম
শুধু গানবাজনা নয়, ছবি বানানোতেও একইরকম পটু ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। প্রথম ফিচার ফিল্ম 'নাগমতী' বানিয়ে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। তৈরি করেছিলেন ইংরেজি ছবি 'লেটার টু মম'। পরবর্তী সময়ে আরও একটি ফিচার ফিল্ম বানিয়েছিলেন তিনি, তবে সেটি মুক্তি পায়নি। কিন্তু ১৯৯৯ সালে আজকের দিনে আচমকাই ঘটে গেল অঘটন। একটি তথ্যচিত্রের শ্যুটিং সেরে শহরে ফেরার পরে আচমকাই মৃত্যু। চিরতরে থেমে গেল মহীনের প্রধান ঘোড়ার গতি। মাত্র ৫১ বছর বয়সেই কোটি কোটি 'আলোকবর্ষ' দূরে তারাদের দেশে পাড়ি দিলেন বাংলা ব্যান্ডের জনক।
আরও পড়ুন - 'গান গুলো রেখো ভাল', এবার নচিকেতার গলায় বাংলা গজল