১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট তারিখটার গুরুত্ব কোনও ভারতীয়কে বলার প্রয়োজন নেই। ২০০ বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে জেগে উঠেছিল গোটা দেশ। দেশের যে সমস্ত জায়গায় ইউনিয়ন জ্যাক হাওয়ায় উড়ছিল, তা নামিয়ে একে একে তোলা হচ্ছিল ত্রিবর্ণ রঞ্জিত অশোকচত্র শোভিত ভারতের জাতীয় পতাকা। চার দিকে যখন স্বাধীনতার প্রসব যন্ত্রণায় দাঙ্গা বিধ্বস্ত বিভিন্ন অংশে কাতর মানুষ একটু শান্তি খুঁজছেন, সে সময় রেডিওতে এক বাঙালি গায়িকার কণ্ঠে একের পর এক ভজন এবং দেশাত্মবোধক গানে গোটা দেশ মুখরিত হয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী যূথিকা রায়। যাঁকে মহাত্মা গান্ধী ডাকতেন মীরাবাই বলে।
১৯২০ সালে আজকের দিনে হাওড়ার আমতায় জন্মগ্রহণ করেন অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী যূথিকা। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের চাকরিতে বদলিক কারণে বর্তমান বাংলাদেশের খুলনায় চলে যেতে হয় খুব ছোট বয়সে। ছোট থেকেই যূথিকার গানের গলা মুগ্ধ করত সকলকে। মেয়েকে গান সেখানের তাগিদেই ১৯৩০ সালে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ। ছোট থেকে জ্ঞানরঞ্জন সেনের কাছে গানের তালিম নেওয়া শুরু করেন তিনি। ছোট্ট যূথিকার কণ্ঠে মুগ্ধ হন স্বয়ং কাজি নজরুল ইসলাম। তাঁর উদ্যোগেই ১০ বছর বয়সে প্রথম গ্রামোফোনে গান 'স্নিগ্ধ শ্যামবেণী বর্ণা’ রেকর্ড করেন যূথিকা। মল্লার রাগে গানটি নিজেই লিখেছিলেন নজরুল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় গানটি বোর্ডে পাশ না হওয়ায় মুক্তি পায়নি সেই রেকর্ড।
সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত-র সঙ্গে তাঁর জুটি ছিল তৎকালীন সঙ্গীত জগতের অন্যতম সেরা জুটি। সঙ্গীত জীবনের অধিকাংশ গান তিনি কমল দাশগুপ্তর সঙ্গীত পরিচালতেই গেয়েছেন। ১৯৩৪ সালের একটি ঘটনা সম্পর্কে যূথিকা জানান, প্রণব রায়ের লেখা দুটি গান ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি’ সুর করেন কমল দাশগুপ্ত। সে সময় তিনি এইচএমভি-র ট্রেনার ছিলেন। কোনও রকম তালবাদ্য ব্যবহার না করে শুধুমাত্র তারের বাজনা এবং হারমোনিয়াম সহযোগে গান গেয়েছিলেন বালিকা যূথিকা। প্রথম প্রথম সব নতুনকেই গ্রহণ করতে অসুবিধা হয় সকলের। সে সময় রেকর্ড বোর্ডের ডিলারদেরও ওই একই অসুবিধা হয়েছিল। তাঁরা রেকর্ড নিতে চাননি প্রথমে। সে সময় সংস্থার রিটেরা পদে ছইলেন নজরুল। চার বছর আঘেকার স্মৃতি তখনও বেশ টাটকা তাঁর। তিনি একপ্রকার গর্জে উঠলেন। জানিয়ে দিলেন, যদি বিক্রি না হয় সংস্থা সে রেকর্ড ফেরত নেবে। কিন্তু যূথিকার গানের রেকর্ড না নিলে কোনও রেকর্ড ডিলারদের দেওয়া হবে না। অবশেষে ওই বছর নভেম্বর মাসে মুক্তি পায় যূথিকার জীবন বদলে দেওয়া রেকর্ড ভোরের যূথিকা।
স্মৃতি চারনায় এক জায়গায় যূথিকা বলেন, 'সে দিন কাজিদা ওই ভাবে রুখে না দাঁড়ালে হয়তো আমার আর গান গাওয়াই হত না।' এইচএমভি-র উদ্যোগে ভোরের যূথিকা রেকর্ড শোনানো হয়েছিল কবিগুরুকেও। তিনিও গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'এই মেয়েটির গানে যেন চিরকাল এই রকমই পরিমিত বাজনা ব্যবহার করা হয়।।' প্রসঙ্গত বেতারের অডিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিলেন যূথিকা। গানটি ছিল ‘আর রেখো না আঁধারে’। খালি গলায় গাওয়া তাঁর রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে অনেকেই বাহবা দিয়েছিলেন। যূথিকা নিজেও রবীন্দ্র সঙ্গীতে অনুরক্ত ছিলেন। স্মতিচারণে তিনি বলেছেন, 'রবীন্দ্রনাথের গান আমার প্রাণে মিশে আছে। কিন্তু রেকর্ডে গাইতে সাহস পাইনি। ওখানে নিয়মের বড্ড কড়াকড়ি।' হয়তো রবীন্দ্র সঙ্গীতে নিজের আলাদা ঘরানাই তৈরি করে ফেলতে পারতেন তিনি। কিন্তু নিয়মের বেড়াজালে এমন বহু শিল্পী বাধ্য হয়ে রবি ঠাকুরের গানকে সরিয়ে রেখেছিলেন সযতনে।
স্বাধীনতা দিবসের স্মৃতিচারণে যূথিকা বলেছিলেন, '১৫ আগস্ট ১৯৪৭ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে আমাকে দিল্লির রেডিও স্টেশন থেকে ওঁরা ডাকলেন। স্বাধীনতা দিবস বলে আমাকে আমন্ত্রণ জানাননি, এমনিই প্রতি বছর আমাকে ডাকতেন। যেমন গান্ধীজির জন্মদিন, বড় কোনও ফেস্টিভাল – এরকম হলেই আমাকে ডাকতেন। তখন তিনটে করে সিটিং থাকত। প্রথমে সকালে একটা সিটিং থাকতো, সেটা পনেরো মিনিট। তারপরে সন্ধের দিকে একটা সিটিং থাকতো, সেটাও পনেরো মিনিট। তারপর রাত্তিরে, সেটাও পনেরো মিনিট। কী গাইব সেটা ওখানে লেখা থাকতো। রেকর্ডিং শেষ করে আমি সবে বাইরে এসেছি, তখন দেখি যে অফিসরুম থেকে একটা অফিসার ছুটতে ছুটতে এসে হন্তদন্ত হয়ে বাবাকে বলছেন, ‘যাবেন না, যাবেন না, দাঁড়ান আমাদের বিশেষ কথা আছে।’ বাবা দাঁড়াতেই তখন বললেন যে, ‘এইমাত্র আমি ত্রিমূর্তি হাউস থেকে ফোন পেয়েছি। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু নিজে ফোন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রসেশন এখন লালকেল্লায় যাচ্ছে, ওখানে ভাষণ দেওয়া হবে এবং ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা তোলা হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত যেন যূথিকা গান গেয়ে যায়। ওদের তখন প্রসেশন বেরিয়ে গেছে। আমাকে তখন অফিসার বললেন, ‘আপনি শিগগিরই স্টুডিওতে ঢুকে পড়ুন, ঢুকে গান শুরু করুন।’ আমি তখন খুব মুশকিলে পড়েছি। কী গান গাইব, এত বড়ো একটা অকেশন! তার পর যেমন আনন্দ হয়েছে, তেমন ভয়ও হয়েছে, কোন গান দিয়ে শুরু করব। ওই অফিসার তখন বলেন, ‘গান্ধীজি তোমার ভজন ভালোবাসেন, তোমার ভজন রোজ শোনেন রেকর্ড বাজিয়ে, তুমি সেই ভজন দিয়ে শুরু করো। পরপর তুমি গেয়ে যাবে, থামবে না। পরপর গেয়ে যাবে, যতক্ষণ না আমরা তোমায় ইশারায় জানাব।’ আমি তো ঢুকে পড়লুম স্টুডিওতে। এটা ঠাকুরেরই আশীর্বাদ, আমার মনে পড়লো একটা স্বাধীনতার গান, ‘সোনেকা হিন্দুস্তান মেরা, সোনেকা হিন্দুস্তান মেরা’, এটা দিয়েই আমি আরম্ভ করেছিলাম। তখন তো রেকর্ড হত। রেকর্ডে দুটো গান থাকত। ‘হিন্দুস্তান মেরা’র অপর পিঠে ছিল, ‘ভারত মেরি জন্মভূমি হ্যায়’। তা আমি ‘হিন্দুস্তান মেরা’ দিয়ে আরম্ভ করলাম এবং তারপরে গান্ধীজি যে সমস্ত ভজন ভালোবাসতেন, যেমন ‘ম্যায় তো গিরধর আগে নাচুঙ্গি’। তারপর এই ভজন যতো ছিল আমার সেই গানগুলো দিয়ে আমি প্রায় একঘণ্টা মতো গেয়ে তারপর ওখান থেকে সংকেত পেলাম যে এ বার ‘বন্ধ করো’। এটা আমার সংগীত জীবনের একটা খুব বড় স্মৃতি।'