'বাবু… বাবু রে… বাবু…', বর্তমানে বাংলা টেলিভিশনের ভীষণ জনপ্রিয় ডায়ালগ এটি। আরও জনপ্রিয় বাবুর মা। ঠিক ধরেছেন! নিম ফুলের মধুর কৃষ্ণা প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছে। পর্ণার শাশুড়ির চরিত্রে নজরকাড়া অরিজিতা মুখোপাধ্যায়। থিয়েটারের মঞ্চ থেকে শুরু। বর্তমানে বাবুর মা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। তবে ধারাবাহিকের আর পাঁচজন ভিলেনের মতো বাস্তব জীবনে তাঁকেও বেশ চাপের মুখে পড়তে হয়। রিল আর রিয়েলের ফারাক ভুলে অনেকেই অরিজিতার উপর চড়াও হয়েছেন। আর তা নিয়েই এবার bangla.aajtak.in-এর কাছে মুখ খুললেন অরিজিতা।
অভিনয়ের জন্য ছিপছিপে হওয়ার প্রয়োজন নেই, এই ট্রেন্ডটা মনে হয় তুমি শুরু করেছে টলিউডে, কী বলবে?
অরিজিতা: না, আমার সেটা মনে হয় না কারণ দেখো আমি যদি সেই পুরনো দিন থেকে শুরু করি তাহলে মলিনা দেবী ছিপছিপে ছিলেন না। আমার মনে হয় পুরনো দিনে আমাদের সাধারণ চেহারাটাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। তখন মানুষ অভিনয় দেখতেন, পারফর্ম্যান্স দেখতেন। এখন লুক জিনিসটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এটা অনস্বীকার্য, চরিত্র কেমন দেখতে হবে সেটা তো কারোর চিন্তা-ভাবনা হতেই পারে, কিন্তু চরিত্রকে সবসময় ওরকমই দেখতে হবে এই ট্রেন্ড মনে হয় সমাজ তৈরি করল বলে তৈরি হল। মানে ইন্ডাস্ট্রি আলাদা করে তৈরি করল কী আমার মনে হয় না। আবার পরিপূরকও বলা যেতে পারে, মানে ইন্ডাস্ট্রি ছবিতে ওরকম দেখালো তাই মানুষের ধারণা তৈরি হল, এটা অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে এরকম প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ছিলেন, এমন মহিলারা ছিলেন না তা নয়, কিন্তু খুব সচেতনভাবে নিজের শরীরকে নিয়ে কথা বলা, বডি পজিটিভিটি নিয়ে কথা বলা সেটা যদি বল তাহলে অবশ্যই আমার আগে লোকজন বলেছে। আমি স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কেই বলতে শুনেছি, তখনও আমি ইন্ডাস্ট্রিতে আসিনি। তাঁর শরীর নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করা হত। তাঁর স্তন, বয়স ইত্যাদি নিয়ে খারাপ মন্তব্য হতো। তো সেগুলো নিয়ে উনি সরব হয়েছিলেন এবং তারপরে অনন্যা অনেকদিন ধরে কাজ করছে ইন্ডাস্টিতে, ও আমার বন্ধুও। অনন্যাও এই ধরনের চরিত্রে ইতিমধ্যে কাজ করেছে এবং কথা বলেছে। তো আমি নিজেকে একমাত্র কখনই বলতে পারি না। তবে আমি সেই কয়েকজনের মধ্যে পড়ি যে এই বৈষম্য নিয়ে কথা বলে।
ইংল্যান্ডে থিয়েটার প্রশিক্ষক হয়ে ছ'মাস কাটানো, দেশে ফিরে গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া... এ সব ছেড়ে হঠাৎ সিরিয়াল কেন?
অরিজিতা: দেখো, অভিনয় অনেক ছোটবেলা থেকে করতাম। আসলে অভিনয়টাকে যদিও বা পেশা করি, ছোটবেলায় তো ধারণা স্পষ্ট থাকে না। থিয়েটার করব, থিয়েটারটাকে খুব সিরিয়াসলি করব কিন্তু তার পাশাপাশি পড়াশোনাটাকেও মন দিয়ে করতে বলা হয়েছে, কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা সেন্টিমেন্ট থাকে, ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো হবে, পড়াবে না হলে উকিল হবে। আমাদের মতো পরিবার যাঁরা, যেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হলে অধ্যাপক হবে ইত্যাদি এই বিষয়টা কাজ করে। সেই চিন্তাভাবনার মধ্যে বড় হয়েছি এবং আমাদের বাড়িতে পড়াশোনাটাকে অসম্ভব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, জীবনে আমি একটা জিনিসকে খুব ভয় পেতাম যে পড়াশোনা গণ্ডগোল করলে মা-বাবা আমায় মেরে ভূত ভাগিয়ে দেবে আর কী। একটা পড়াশোনাজনিত প্রেসার ছিল। এরকম নয় যে অঙ্ক নিয়েই পড়াশোনা করতে হবে, কিন্তু যেটা নিয়ে পড়ছ সেটা যথাযথভাবে পড়, এই চাপটা ছিল। তাই আমি সত্যিই কোনওদিন ভাবিনি যে পর্দায় অভিনয় করে কিছু করব বা এটাকে পেশা করব। যেটা হয় আমার বেশ কয়েক বছর থিয়েটারটা বন্ধ ছিল, সেটা আবার শুরু হয় ২০১১-১২ সাল থেকে, থিয়েটার করা শুরু করি, থিয়েটার নিয়ে লেখালিখি করা শুরু করি। এরপর ইংল্যান্ডে যাই, সেখান থেকে ফিরে নিজের দল তৈরি করা। তার সঙ্গে কালচার অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পড়াশোনা করি, পিএইচডি করার সুযোগ পাই। ওখানে রিসার্চ অ্যাবিলিটি টেস্ট হয়, এই কোর্স নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার অভিনয় সম্পর্কে পুরো ধারণাটাই পাল্টে যায়। আমার পারফম্যান্স স্টাডি কোর্স ওয়ার্কে ছিল, আমি বুঝতে পারি যে, অনেকগুলো দিক উঠে আসে। প্রথমত অভিনয়ের দর্শন কী হবে, কতরকম স্কুল অফ থটস রয়েছে, আমি কোনটাতে নিজেকে ফিট করতে পারি, এ ধরনের বড় ইস্যু থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বৈষম্য নিয়েও পড়াশোনা হতে শুরু করে, তখন আমি বুঝতে পারি যে মানুষের মনে টিভি বা টেলিভিশনকে নিয়ে খুব একটা নাক সিঁটকানো ভাব ছিল। মানে কেন এটা, টেলিভিশনের তো অনেক দর্শক। আমি বলছি না যে এটাই আমার কাজ করতে আসার প্রধান কারণ। এটা বুঝতে পেরেছিলাম সেই সময়। টেলিভিশনে আসার আগে। এরপর আমি একটা চাকরি শুরু করি। আইসিএসসি কাউন্সিলের আন্ডারে একটা স্কুলে বাংলা সাহিত্য পড়াতাম এবং সেই স্কুলের উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের নিয়ে একটা-আধটু নাটকও করাতাম, সেই করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে শিক্ষাব্যবস্থাকে আমি যেভাবে দেখি আর এখন যেভাবে দেখা হয়, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার দম আটকে আসে। আমি চাকরি ছাড়তে চাইছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না যে চাকরি ছেড়ে কী করব। পিএইচডি সম্পূর্ণ হলে না হয় অন্য চাকরির কথা ভাবা যায়। কিন্তু এখন? এই দোলাচলে ছিলাম আর কী, অন্য চাকরির জন্য আবেদন করছিলাম, বাইরে বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় আমার কাছে একটা অফার আসে, আমায় সাহানা দত্ত কল করেন। উনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমি যাই। উনি তখন আমাকে একটা কাজ করতে বলেন। সেই চরিত্রটা দারুণ, লুক সেটও হয়ে যায়। কিন্তু সবকিছু ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পরে চ্যানেল থেকে আমায় না বলে দেওয়া হয়। আমি রিজেক্ট হয়ে যাই। অথচ অডিশন ভালো হয়েছিল, সবাই নিতেও চেয়েছিল, কিন্তু কোনও একটা জায়গা থেকে না হয়ে যায়। খুব সম্ভবত বিসনেজ সাইড থেকে না-টা আসে। আর এই না হয়ে যাওয়ার পরে আমার প্রচণ্ড একটা অনুভূতি কাজ করতে থাকে এই গোটা বিষয়টাকে নিয়ে, দুটো দিন আমি লুক সেট আর অডিশনের মধ্যে লম্বা সময়ের মধ্যে ছিলাম, তাই আমার মনে হতে থাকে অভিনয়টাকেই কেন পেশা হিসাবে নিলে হয় না। আমি যে জিনিসটা করতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, যে জিনিসটা করলে আমার স্বস্তি লাগে, আমি যখন থিয়েটার করি, মঞ্চে উঠি বা রিহার্সালে যাই, ওটা আমার খুব নিজস্ব জায়গা, আমি যদি এই জায়গাটাকে পুরো সময় দিতে পারি, এখান থেকে উপার্জন করতে পারি, আমি তো এটা নিয়ে পড়াশোনা করছি, তাহলে এটাকে পেশা হিসাবে নিলে কেমন হয়। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না যে কীভাবে কাজের জন্য মানুষকে বলতে হয়। তারপর আবার কিছুদিন পরে সাহানা দি ডেকে পাঠান, তখন অন্য একটা চ্যানেলে অন্য প্রজেক্ট আসছিল। ওখানে সাহানা দি আমায় লঞ্চ করেন, আমি খুব দারুণ একটি চরিত্র করি। আমার প্রথম সিরিয়াল হয় আয় খুকু আয়।
কেন ছাড়লে স্কুলের চাকরি?
অরিজিতা: আয় খুকু আয় সিরিয়াল করার সময় স্কুলের চাকরি ছাড়িনি। সকালে স্কুল করে বিকেলে দৌড়াতে দৌড়াতে শ্যুটিং করতাম। সিরিয়ালের মাঝামাঝি পরিস্থিতিতে সাহানা দি জানতে পারেন যে আমি চাকরি ছাড়িনি। সাহানা দি আমায় বলেন যে সিরিয়ালে এতটা সময় দিতে হয় যে তুমি দুটো একসঙ্গে বজায় রাখতে পারবে না। আমাকে বেছে নিতে হবে নয়তো আমাকে নিয়ে বড় কিছু ভাবা যাবে না। খুব অনিশ্চয়তার একটা জায়গা যদিও, আমি তো চাকরি করা মানুষ, আমার ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা লাগছে। আজকে কাজ আছে তো নেই, কোনও মাসে ১০ টা ডেট তো কোনও মাসে ১২টা ডেট। আমি তখন ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বললাম, যাঁদের সঙ্গে তখনও পর্যন্ত কাজ করেছি। তাঁরা সকলে আমাকে বললেন যে দেখো আমাদের জীবনটাই এরকম, তুমি যখন উপার্জন করবে তখন বর্ষার দিনের জন্য জমিও। আমিও ভাবলাম দেখি না ঝুঁকি নিয়ে, এটাই আমার জীবনের হাই টাইম। আমি জাস্ট দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। আর আমার জার্নি শুরু হল। করোনা মহামারির সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর কোনওদিন দাঁড়াতে পারব না। আমার চাকরি ছাড়ার ৭-৮ মাসের মাথায় মহামারি শুরু হয়। এই জীবনে ধাক্কাটা খেয়ে বুঝে নিয়েছিলাম যে রেইনি ডে-এর জন্য সেভ করতে হয়। যখন ভীষণ হতাশায় চলে গিয়েছি, তখন ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়ররাই সুপারিশ করেছে কাজের জন্য। আসলে কাউকে চিনতাম না, তাই কাজ চাইতে পারিনি সেভাবে। ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়ররাই সাহায্য করেছে। এভাবেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবেই চলতে থাকল। নিম ফুলের মধু করার আগে সিনেমা-সিরিজ করলাম। এরপর ফাটাফাটি করলাম, সৃজিত দার সঙ্গে এর আগে এক্স=প্রেম ছবিতে একটা দৃশ্যেই অভিনয় করেছি, কিন্তু সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। হচ্ছে, আস্তে আস্তে টুকটুক করে কাজ হচ্ছে। মানুষজন ডাকছেন, কাজ করতে পারছি, আমার কাছে এটা অনেক।
আয় খুকু আয়, সম্পূর্ণা, ইন্দু, কুলের আচার আর এখন নিম ফুলের মধু, তিন-সাড়ে তিন বছরের টানা কেরিয়ারে তোমার চেহারা কী কখনও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
অরিজিতা: হ্যাঁ, একাধিকবার। আমার ধারণা আমার প্রথম রিজেকসনটা এই জন্যই হয়েছিল। এরপর আমাকে আরও এক রিজেকসনের মুখে পড়তে হয়, যেখানে আমায় বলা হয় আমাকে বড়সড় দেখতে। এরকমও হয়েছে লুক টেস্ট হয়ে গিয়েছে, ফ্লোরে প্রজেক্ট যাবে, আমি ইতিমধ্যে অন্যদের বলে দিয়েছি যে আমি অন্য কাজ নিয়ে নিয়েছি, কাজ শুরু হওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে আমায় না করে দেওয়া হয়, কোনও একটা জায়গা থেকে আপত্তি এসেছে, আমায় নাকি বড়সড় দেখতে লাগছে। এটা সিনেমায় হয়েছে না সিরিয়ালে হয়েছে বলছি না, কিন্তু এটা হয়েছে। আমার খুব খারাপ লাগছিল যে আমাকে আমার বয়সের চেয়ে বড় চরিত্র অফার করছিল। দেখো সিরিয়ালের গুরুত্ব ও চরিত্রের গুরুত্ব দেখে কাজ করি, সেক্ষেত্রে প্রথম গুরুত্ব থাকে হিরোইন আর তারপর তাঁর শাশুড়ি, মা। তো সিরিয়ালে আমায় হিরোইন করবে না আমি জানি তাহলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল শাশুড়ি, মা অথবা কোনও ভিলেন। এরকম চরিত্রগুলো নিতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। কারণ সিরিয়ালের ক্ষেত্রে গুরুত্বটা দরকার, রেগুলার কাজটা দরকার, প্রত্যেকদিন মানুষের কাছে নিজেকে নিয়ে যাওয়াটা দরকার। সিরিয়ালের ক্ষেত্রে আমি এই জিনিসগুলো করব। কিন্তু সিনেমাতে আমি চরিত্রের গুরুত্ব দেখব, সেটা আমার বয়সের নেই সেটা তো হতে পারে না। আমি খুব দুঃখ পাচ্ছিলাম। তখন আমার কাছে কিছু চরিত্র এসছিল, যেগুলো আমাকে বয়সের চেয়ে বড় চরিত্রের অফার করেছিল, আমি না বলে দিয়েছিলাম। আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের না বলেছিলাম। আমার তো এত বয়স নয়, আমায় কী কোনওভাবেই আমার বয়সী চরিত্র দেওয়া যায় না। ঠিক তখনই এক্স প্রেম-এর জন্য আমার কাছে অডিশন চাওয়া হয়। আমি অডিশন দিই এবং কিছুদিনের মধ্যেই আমার কাছে ফোন আসে যে সৃজিত মুখোপাধ্যায় আমায় সিলেক্ট করেছেন। আমার অডিশন দিতে গিয়ে এই চরিত্রটা করতে আমার ভালো লেগেছিল। আমায় সৃজিত মুখোপাধ্যায় ও তাঁর টিম থেকে বলা হয়েছিল যে আমার স্ক্রিন প্রেজেন্ট খুব ভালো। এটা আমি বুঝতে পারি যে স্ক্রিন প্রেজেন্ট হল আমাকে কী রকম দেখতে সেটা নয়, আমি কোন এক্সপ্রেসনে নিজেকে পেশ করছি সেটা। আমি কী পারফর্ম করছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার আত্মবিশ্বাস অনেকটা বাড়ে। মাঝে আমার সাইকোলজিক্যাল ট্রমা তৈরি হচ্ছিল এই ভেবে যে আমায় অ্যাভারেজ দেখতে বলে আমি প্রচুর কাজ হারিয়ে ফেলেছি, মানে সকলেই বলছেন পরে জানাবেন।
তোমাকে তো শাড়ি পরতেও অনেকে বারণ করেছিল?
অরিজিতা: আমাকে অনেকে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেই ফেলেছে যে একটু কম শাড়ি পড়বি অরিজিতা, তাহলে হয়ত তোর বয়সী রোল পাবি। কিন্তু কেন আমি শাড়ি পরা ছাড়ব, আমি তো সেই কলেজের দিন থেকে শাড়ি পরি, প্রেসিডেন্সিতে পরার সময় এমন অনেক মহিলাদের দেখতাম যাঁরা বাড়ির শাড়ির ভাণ্ডার পরে আসতেন। এটাই ট্রেন্ড ছিল। আমি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছি, যেখানে শাড়ি সব। আমি এত সুন্দর একটা সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি হঠাৎ করে শাড়ি পরা ছেড়ে দেব কী করে। অন্যদের মতে শাড়ি পরা ছেড়ে দিলে, কাস্টিংয়ে হেল্প হয়। হয়ত বন্ধু হিসাবেই বলছে লোকজন, কিন্তু এগুলো শুনতে শুনতে না ট্রমা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এক্স প্রেম-এ যখন সিলেক্ট হই তখন আমার জন্য ভালো সময় ছিল না, কাজ ও আর্থিক দিক দুটোই ডাউন ছিল। তবে এই সিনেমাটা করতে গিয়ে আমায় ওইদিনটা একটা কনফিডেন্ট ফেরৎ দিয়েছিল। আমি আবার টুকটুক করে সিরিয়াল করতে শুরু করলাম। লকডাউনের পর জীবনের দ্বিতীয় ইনিং শুরু হল। এরপর ফাটাফাটি-র অফার যখন এল আমার কাছে ততদিনে তো আমি এইসব বিষয় নিয়ে রীতিমতো সরব।
সমাজে মোটাদের নিয়ে এত কেন সমস্যা?
অরিজিতা: টলিউডে ফাটাফাটি সিনেমাটা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমি পরিচালককে বলেছিলাম যে আমি যে কোনওভাবে এই সিনেমাটার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে রাজি ছিলাম। কারণ আমি নিজে যে বৈষম্যটার মুখোমুখি হই সেটা যে কতটা ট্রমার মধ্যে নিয়ে যেতে পারে আমি জানি। অন্য জায়গার কথা আমি জানি না, অন্তত বাংলার বুকে যদি তুমি মোট হও তাহলে মানুষ সেটা নিয়ে মজা করবেই। আর যদি তুমি রেগে যাও তাহলে লোকে বলবে তুমি ওভার রিয়্যাক্ট করছ। এটা যে একটা বৈষম্যমূলক আচরণ সেটা কেউ মানতেই রাজি নয়, বরং বলবে মোটাকে মোটা বলব না। আমার বক্তব্য মোটাকে মোটাই বলবে, ডিকশনারিতে সেটাই বলা আছে। আমি স্থুলকায় হলে আমাকে মোটাই বলবে তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি কোন অ্যাপ্রোচে মোটা-টা বলছ। তুমি আমার বর্ণনা দিতে গিয়ে এটা বলতেই পারো যে ওই যে একটা দিদি আছে না, গোলগাল, মোটা, কপালে বড় টিপ পরে, অর্থাৎ তিমি আমায় কোনও জাজমেন্ট ছাড়া আমার বর্ণনা দিচ্ছ। সেটা আলাদা। আমি সেটা নিয়ে কথা বলছি না। কিন্তু তুমি যদি বল, আরে ওই ধুমসীটা বা ওই ঢেপসীটা, তুমি ইতিমধ্যেই রিপ্লেস করে দিচ্ছ মোটা শব্দটাকে একটা অশালীন শব্দের সঙ্গে, কারণ তোমার মধ্যে মোটাদের নিয়ে এতটাই ঘৃণা আছে। এটা এক ধরনের ফ্যাট ফোবিয়া। মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে ফ্যাট ফোবিয়া রয়েছে। আরেকটা জিনিস তো ভীষণভাবে রয়েছে মেয়ে মানুষ মোটা হবে কেন। এটা সাম্প্রতিককালে হয়েছে, আগে এরকম ছিল না সমাজ। আসলে আমার শরীরের কাঠামোটা চওড়া। স্কুলে পড়ার সময়ও যখন আমি রোগা ছিলাম আমাকে মোটা বলা হত। সেই সময় বুঝিনি, তবে যত বড় হয়েছি, বুঝতে পেরেছি যে এটা সমাজের গভীরতম অসুখ। কাউকে মোটা বলা যে কতটা অপমানজনক এটা অনেকেই সনাক্ত করতে পারেন না। অর্ধেকের বেশি লোক জানেনই না যে কাউকে ঢেপসী বললে তাঁর খারাপ লাগতে পারে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে আমার মনে হয়েছিল যে ফাটাফাটি খুব ইন্টারেস্টিং সিনেমা, যেখানে বলা হয়েছে সমস্যা সম্বোধনে নয়, আপনার অ্যাপ্রোচে। এই অপমানগুলো এবার বন্ধ হওয়া দরকার। আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র রিঙ্কু দি এই ফাটাফাটি সিনেমায় আমি অভিনয় করি। এই রিঙ্কু দিকে নিয়ে অনেক কিছু করা গিয়েছে।
বিনোদন বা গ্ল্যামার দুনিয়ায় টিকতে হলে ইউ মাস্ট বি গ্ল্য়ামারস, স্লিম-ট্রিম, এটাকে কি মানো তুমি?
অরিজিতা: এই মিথটার মধ্যে অসম্ভব পলিটিক্যাল ভুল রয়েছে। সেটা হল গ্ল্যামারস হওয়ার সঙ্গে স্লিমের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি প্রচণ্ড মোটা আর ভীষণ গ্ল্যামারস হতেই পারি। মোটা হোক, রোগা হোক, কালো বা ফর্সা, গ্ল্যামারস যে কেউ হতে পারে, যদি তাঁরা মন থেকে গ্ল্যামারস হয়। সেটা তাঁদের জীবন চর্চার মধ্যে থাকে। এবার স্লিম-ট্রিম হল একটা বডি টাইপ, ফ্যাট একটা বডি টাইপ, এর মাঝে যাঁরা আছে তাঁদের একটা বডি টাইপ। এগুলো সব আলাদা আলাদা বডি টাইপ। এই সব ধরনের বডি টাইপ যদি ইন্ডাস্ট্রিতে না থাকে, তবে সেই ইন্ডাস্ট্রি কোনওদিনও ফুলে ফলে ভরবে না। কারণ ইন্ডাস্ট্রিতে সবাইকে এক রকম দেখতে হয়ে যাবে। কারণ সব চরিত্রকে এক রকম দেখতে হলে তো বিপদ। আমরা যাঁরা রূপোলি পর্দার মানুষ, তাঁরা তো বাস্তব জীবনটাকেই তুলে ধরি সিনেমা বা ওয়েব সিরিজে। তো বাস্তবে তো অনেক রকমের দেখতে চরিত্ররা রয়েছে। তাহলে সেই অনেক রকমের চরিত্ররা যদি না আসে তাহলে তো বিপদ হয়ে যাবে। এটা একেবারেই তাই ভুল কথা। প্রথমত, গ্ল্যামারস সবাই হতে পারে, তাঁদের প্রত্যেকের সমস্যা নিয়ে। তাই এটার কোনও মানেই নেই, এটা একেবারেই বাজে কথা।
আমাদের সমাজে বডি শেমিং একটা অভিশাপের সমান, কতবার এটার মুখোমুখি হয়েছো?
অরিজিতা: বহুবার হয়েছি বডি শেমিং-এর শিকার। প্রচুর উল্টোপাল্টা কথা শুনি রোজ। নিম ফুলের মধু সিরিয়ালে আমি প্রচুর দুষ্টুমি করি, সেখানে আমায় লোকে কূটনী সহ অনেক কিছু লেখে আমি সেগুলোতে মজা পাই। এবার লোকের রাগ বাড়ছে, কারণ আমার দুষ্টুমিও তো বাড়ছে। কিন্তু এবার মানুষের কমেন্ট বদলাচ্ছে। তখন বলছে মুটি, ঢুমসী বুড়ি একটা। মানে রাগের চোটে এমন একজনকে আক্রমণ করছে যে চরিত্রটা আসল নয়, সত্যি সত্যি কৃষ্ণা দত্ত নয়, ওটা কাল্পনিক চরিত্র। তুমি না বুঝে কাল্পনিক চরিত্রের পাশাপাশি আসল চরিত্রটিকেও অ্যাটাক করছ। আগে এই ধরনের কমেন্ট পড়ে আমি বিচলিত হতাম। আমি কাঁদতাম, কষ্ট হত, অবসাদে চলে যেতাম। কৃষ্ণা দত্তের ওপর রাগটা কেন সেই ব্যক্তিকে শুনতে হচ্ছে। লোকে বলছে তোমার নাক খ্যাঁদা, চোখ ট্যাঁরা, এটা বেশ ওটা কম, এগুলো কী, ইয়ার্কি হচ্ছে। কারোর ওপর রাগ থাকলে আমি তাঁর বডি নিয়ে এভাবে কথা বলব। আর সেই সব কমেন্টে অন্যদের ১৫-১৬ টা হা হা রিয়্যাক্ট। আগে এগুলো দেখলে ডিপ্রেসড হতাম। এখন আর পাত্তা দিই না। এখন আমি গ্রো করেছি, সহনশীলতা বেড়েছে। আমি আমার মতো করে চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিবাদ। আমি চেষ্টা করছি এই স্টিরিওটাইপ যতটা ভাঙা যায়। মানুষ এমনিও ফিট ও ফ্যাটের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে। নিম ফুলের মধু শুরু হওয়ার দু মাসের মধ্যে একটি দৃশ্য আসে, যেখানে পাড়ায় স্পোর্টসের প্রতিযোগিতা হবে। সেই প্রতিযোগিতাটা হয়, সত্যিকারের হয়। সেখানে মাঠ ভাড়া করা হয়, প্রচুর জুনিয়র আর্টিস্ট নিয়ে এটা হয়। সাজানো গল্প হলেও আমাদের ঠাঁ ঠাঁ রোদে সবকটা স্পোর্টস করতে হয়েছে। ভোর সাতটা থেকে শুরু হয়েছে আর যখন রাত নটায় এসে শেষ হল, আমার মনে আছে বলব না কে বা কারা, ইউনিটের অনেকে তো বটেই অন্য অনেকে আমায় এসে বলেছিল যে তাঁরা নাকি ভেবেছিল যে আমি নাকি শেষপর্যন্ত টানতে পারব না। কিন্তু তাঁদের মতে আমি নাকি এতটাই ফিট যে প্রথম শর্টটা যেভাবে দিয়েছি, শেষ শর্টটাও সেভাবে দিয়েছি। আমি তখন বলেছিলাম যে আমার ভালো লাগলো যে তোমরা এটা এসে আমায় বলেছো কিন্তু অবাকও লাগছে যে এটা তোমরা ভেবে নিলে কী করে যে আমি পারব না, শুধুমাত্র মোটা বলে। আমি এর মুখোমুখি হয়ে বুঝেছি যে এই ঘটনাটা কতটা সিরিয়াস হতে পারে, আমি এটা নিয়ে রীতিমতো আপত্তি জানাই।
নিম ফুলের মধু-তে বাবুর মা তথা কৃষ্ণা দত্ত এখন তো দারুণ জনপ্রিয়, ছেলের মা যদি কখনও হও নিজেকে কি কৃষ্ণা দত্তের মতোই দেখতে চাও?
অরিজিতা: নিজেকে কোনওদিন মা হিসাবে কল্পনাই করিনি এখনও। তবে যদি কোনও ছেলের মা হই তাকে তার মতো করে বড় হতে দেব, ভালো-মন্দটা শিখিয়ে। তার জীবনটা তো তার জীবন, সেটাকে তো আমি আমার করতে পারি না। আমি নিজেই কৃষ্ণার ওপর রেগে যাই, আমি তো নিজেকে পর্ণার চরিত্রে মনে করি। আমারই নিজেরই রাগ হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
রাস্তায় বেরোলেই তো এখন সবাই বাবুর মা বলেই ডাকে, কেমন মনে হয়?
অরিজিতা: একটু কেমন কেমন লাগে, তবে ভালো লাগে। এই চরিত্রটা তো অনেক কিছু দিয়েছে। সিরিয়ালের টিআরপিও এখন একটা জায়গা ধরে রেখেছে, আমার পরিচিতি বেড়েছে। ভালো লাগে মানুষ এসে বলেন যে আমার জন্য তাঁরা এই সিরিয়াল দেখেন বা আমার জন্য অপেক্ষা করেন তাঁরা। এটা খুবই ভালো লাগে। দেখো দিনের শেষে তো এটুকুই পাওয়া আর কী। একটু তারিফ পাই। শিল্পীরা তারিফের কাঙাল। যাঁরা বলেন তাঁদের দরকার নেই তাঁরা মিথ্যা কথা বলেন। আমি কিছু প্রদর্শন করলে তার তো প্রতিক্রিয়া আশা করবই। আর প্রতিক্রিয়া ভালো হলে ভালো লাগে।
নিমফুলের মধু-তে ঝাঁঝালো মশলার কাজ করে কৃষ্ণা দত্ত, তা সত্ত্বেও কী পর্ণার সঙ্গে তাঁর শাশুড়ির মিল দেখতে পারবেন না দর্শকেরা?
অরিজিতা: আমি সত্যি এটা জানি না। কোনও ধারণা নেই। এখনও তো দেখতে পাওয়ার কোনও চান্স আমি দেখছি না। আমার ও পল্লবীর (পর্ণা) যেটা মনে হয় যে এখন হয়ত কৃষ্ণার পর্ণাকে ভালোই লাগে। কারণ আমি যেভাবে স্ক্রিপ্টগুলো পাই, সেগুলো পরিবেশন করি তাতে মনে হয়েছে কৃষ্ণার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে পর্ণার সঙ্গে থাকতে থাকতে। কৃষ্ণার মনে মনে পর্ণাকে ভালোই লাগে, আসলে কৃষ্ণা খুব ছেলেমানুষ একজন মহিলা। কৃষ্ণাকে আমি একশো শতাংশ খারাপ দেখি না। কৃষ্ণার ছেলে নিয়ে অবসেশন রয়েছে সেটা আর কী করা যাবে।
ফাটাফাটি-সিনেমার মতো টলিউডে আর এরকম সিনেমা হতে পারে বলে মনে হয়, যেখানে স্থুলকায় মহিলা প্রধান চরিত্রে থাকবে?
অরিজিতা: হচ্ছে না একেবারে তাতো বলা যাবে না। অপরাজিতা আঢ্যকেই দেখো, ফাটিয়ে অভিনয় করছেন, সকলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। তিনিও স্বাস্থ্যবতী কিন্তু তিনি দারুণ দারুণ চরিত্রে অভিনয় করেন। একান্নবর্তী সিনেমাতে আমরা অনন্যা সেনকে দেখেছি অভিনয় করতে। বিভিন্ন ওয়েব সিরিজে ও সিনেমায় অনন্যা ও আমি যখন অভিনয় করেছি, তখন তো কেউ আমাদের বলছেন না যে আমি বা অনন্যা স্থুলকায়। এগুলো অনেক ভালো প্রতিবাদ। এরকম ছবি আরও হলে ভালো লাগবে, খারাপ কেন লাগবে। তবে এক্ষেত্রে নতুন নতুন বিষয়ের ওপর হলে ভাল হয়। তবে তার সঙ্গে এটাও স্বাভাবিক হওয়া দরকার যে অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে এমন একটা চরিত্রও রয়েছে যে মোটা বা রোগা বলে নয়, তাঁর ভালো অভিনয়ের জন্য তাঁকে কাস্ট করা হয়েছে।
নাটকটাকে মিস করো?
অরিজিতা: নাটকটাকে খুব মিস করি। আমি শেষবারের মতো নাটক করেছি চন্দননগরের রীবন্দ্রভবনে ২ মাস আগে। আমি থিয়েটার করছি, করছি না তা নয়, তবে কম শো করছি, নতুন কোনও শো করতে পারছি না কারণ সময় দিতে পারছি না মহড়াতে। আর আমি দলের সঙ্গে মহড়া না দিয়ে কাজ করতে পারব না, সেই সাহসই আমার নেই। তবে স্টেজে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিলে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। মঞ্চ দিয়েই তো শুরু, একসময় এই স্টেজকে ভয় পেতাম। কিন্তু যতদিন গিয়েছে সেই ভয়টা কেটেছে, স্টেজে উঠলে খুব হালকা লাগে। এই নাটককে খুব মিস করি।
তোমার কাছে স্টাইল স্টেটমেন্টের অর্থ কী?
অরিজিতা: যেটাই পরবে, সেটা গয়না হোক বা পোশাক, সেটা যেন তোমায় স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। বাকিটা তোমার পছন্দ অবশ্যই। খুব মনখোলা হও, স্টাইল স্টেটমেন্ট হল যেটা মানুষ খুব বিশ্বাস নিয়ে ক্যারি করতে পারেন। স্টাইল স্টেটমেন্টের সঙ্গে স্টেটমেন্টের সঙ্গে একটা বিশ্বাস জড়িয়ে রয়েছে। তুমি যেটা পরছ সেটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরবে এবং সেটা পরে হেঁটে যাবেন, ফ্লন্ট করবেন বা করবেন না। তুমি কনফিডেন্ট হলে বিকিনি হোক বা শাড়ি সবেতেই তুমি স্টাইলিস্ট।