
হাতে গোনা কয়েকটা দিন। আর তারপরই ২০২৫ সাল বিদায় নেবে। এই বছরটা হিন্দি ও বাংলা ছবির ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য বছর বলা চলে। কিছু ভাল ভাল সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এই বছরেই। যা দর্শকদের মন ভাল করেছে, আবার কাঁদিয়েছেও। এ বছর বাংলা সিনেমা নিজের ভেতরের ভাষাটাকেই নতুন করে চিনে নিয়েছে। চেনা ছকের বাইরে এসে গল্পেরা কথা বলেছে আলাদা স্বরে, আলাদা অনুভবে। হিন্দি ছবির ক্ষেত্রেও তাই, এমন কিছু গল্প সেখানে বলা হয়েছে, যা দর্শকরদের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেরকমই কিছু ১০টি সেরা সিনেমার কথা বলব, যা এই বছর মন জয় করেছে দর্শকদের।
‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’
নতুন করে বলার কোনও জায়গা নেই বাঙালি এই গোয়েন্দা দর্শকদের মনে ঠিক কতটা জায়গা করে ফেলেছেন। তাই ওটিটি থেকে বড়পর্দা, যখনই একেন তথা একেন্দ্র সেন আসেন, তাঁকে দেখতে দর্শকেরা ভিড় জমান হলে। একেন বাবু, বাপি আর প্রমথর বন্ধুত্বের রসায়ন এবার গড়িয়ে পড়ে বেনারসের ঘিঞ্জি গলি আর ঘাটের ধারে। রহস্য এখানে শুধু ধাঁধা নয়; হাসি-ঠাট্টা, টানটান অনুসন্ধান আর বন্ধুত্বের উষ্ণতায় গল্পটা ধীরে ধীরে খুলে যায়। পাথরের শহরের আধ্যাত্মিক আবছায়া যেন রহস্যের সঙ্গে মিশে গিয়ে দর্শকের মনেও আলাদা এক অনুভব রেখে যায়।
আমার বস
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় সব সময়ই তাঁদের সিনেমার মাধ্যমে সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত নার্স তাঁর বস ছেলেকে বুঝিয়েছেন তাঁর সহকর্মীদের ভাল থাকার চাবিকাঠি তাঁরই হাতে, তাঁরা ভাল থাকলে কাজটাও সেরা মানের হবে। নিঃশব্দভাবে এই গল্প দর্শকের মনে জায়গা করে নেয়।
গৃহপ্রবেশ
এই ছবিতে যে গল্প বলা হয়েছে, তা সাধারণ হলেও কোথাও যেন অসাধারণ। এক মহিলা যিনি চোখে সংসার করার স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা দেন, কিন্তু বিয়ের পরের দিনই স্বামী বিদেশে পাড়ি দেন। বিরাট বনেদি বাড়িতে স্বামীর মা-বাবাকে নিয়ে সেই মহিলার একাকীত্বের সংসার। যেখানে হঠাৎ করেই আগমন হয় এক অচেনা মানুষের। যাঁর সঙ্গে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠছিল, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেওয়ার আগেই সেই মহিলাকে দাঁড়াতে হয় আরও এক কঠিন বাস্তবের সামনে। দর্শকদের মন অজান্তেই জয় করেছে গৃহপ্রবেশ।
স্বার্থপর
একটি পরিবারের দৈনন্দিন হাসি-ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এখানে আয়নার মতো ধরা দেয়। এই ছবি মনে করিয়ে দেয়—সব অমিলের পরেও পরিবার মানে আশ্রয়, যেখানে কষ্টও শেষমেশ ভালোবাসার ভাষা খুঁজে নেয়। ভাই-বোনের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় সম্পত্তির কারণে। এই দৃশ্য খুবই চেনা। তাই দর্শকেরাও ভালোবাসায় ভরিয়েছে এই ছবিকে।
পুতুলনাচের ইতিকথা
গ্রামবাংলার এক নিঃশব্দ অথচ গভীর যন্ত্রণার গল্প। মানুষের জীবন এখানে যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা—সমাজ, সংস্কার আর লুকিয়ে থাকা কামনা–বাসনার টানে সবাই নাচে। ডাক্তার শশীর চোখ দিয়ে আমরা দেখি, মানুষ কীভাবে নিজের ইচ্ছের বাইরে অন্যের প্রত্যাশায় বাঁচে। ছবিটি ধীরে ধীরে মনে ঢুকে পড়ে, কারণ এতে কোনো চটক নেই—শুধু জীবনের কঠিন সত্য, যা নীরবে বুকের ভেতর ভার হয়ে জমে থাকে।
হোমবাউন্ড
অস্কার দৌড়ে রয়েছে এই হোমবাউন্ড ছবিটি। সুরতের সুতোকলে কাজ করা দুই বন্ধুর গল্প বলে এই ছবি। বলা যেতে পারে দুই পরিযায়ী শ্রমিকের গল্প। তবে এ গল্প মনগড়া নয়। ভারতের মধ্যপ্রদেশে ঘটে এই ঘটনা। লকডাউনে ভিন রাজ্য থেকে নিজের বাড়িতে ফিরতে গিয়ে দুই বন্ধুর সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা এই ছবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ধুরন্ধর
পাকিস্তানে প্রবেশ করে এক ভারতীয় চর কীভাবে তাঁর মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, এই ছবি সেই চিত্রকে তুলে ধরেছে। একেবারে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। যার ফলে দর্শকদের কাছে প্রতিটি চরিত্র খুবই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। তারই সঙ্গে দেখানো হয়েছে পাক সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমকেও।
হক
এই সিনেমায় একসঙ্গে মিশেছে ন্যায়বিচারের অন্বেষণ, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রশ্ন, ব্যক্তিস্বাধীনতার লড়াই এবং নারীর আত্মমর্যাদার সংগ্রাম। ভারতের ইতিহাসে আলোচিত শাহ বানু মামলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত এই সিনেমার গল্প ভারতীয় সমাজ ও আইনব্যবস্থার অন্তস্তলে পৌঁছে দেয় এক গভীর মানবিক বার্তা। দেশের ইতিহাসে সাড়া জাগানো শাহ বানু মামলার প্রধান ‘চরিত্র’ প্রয়াত শাহ বানু বেগম কীভাবে তাঁর ও সন্তানের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। সব মিলিয়ে ‘হক’ হয়ে উঠেছে এক আবেগঘন, তীব্র ও মননশীল অভিজ্ঞতা।
দ্য বেঙ্গল ফাইলস
এই সিনেমা নিয়ে কম চর্চা হয়নি। ছবির নাম থেকে ট্রেলার, ছবি মুক্তি সব কিছুতেই পরিচালক-নির্মাতারা পেয়েছেন বাধা। তবে হাজারটা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এই ছবি অবশেষে মুক্তি পায়। ১৯৪৬-এর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে রাস্তায় রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। নোয়াখালির দাঙ্গায় গ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দেশভাগে কয়েক লক্ষ মানুষ উৎখাত হয়েছিলেন। বাংলার সেই ক্ষতকেই দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। অতীত এবং বর্তমানকে ব্যঙ্গচিত্রের মত করে, তুষ্টি এবং হুমকির চিত্র তুলে ধরেছে। অবৈধ অভিবাসনকে আজকের নির্বাচনী বিপর্যয় এবং একটি অস্তিত্বগত বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ছাবা
মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত উপন্যাস থেকে মোঘলরাজা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে মারাঠি রাজা শিবাজি মহারাজের ছেলে সম্ভাজি মহারাজের বীরত্ব,তাঁর যুদ্ধের কাহিনি ও আত্মত্যাগ নিয়ে পরিচালক রায়গড়, নাসিক, পুণের প্রেক্ষাপটে অ্যাকশনধর্মী, নাটকীয়তায় ভরপুর একটি চিত্রনাট্য। ছবিতে মহারাষ্ট্র ও সমগ্র মারাঠি জাতির প্রাণপুরুষ শিবাজি মহারাজ, উপস্থিত না থেকেও যেভাবে রয়েছেন, তা অনবদ্য। এই ছবি চলতি বছরে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে বার বার।