সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে করণ জোহর পরিচালিত রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি। আর এই রানি তথা আলিয়া ভাটের বাঙালি মা-বাবার চরিত্রে দেখা গিয়েছে বাংলার দুই অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরী ও চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়। বাঙালি এই দুই অভিনেতার অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে আপামর দর্শককে মুগ্ধ করেছেন তাঁর ডোলা রে ডোলা রে নাচ দিয়ে।
টলিউডে মার্শাল আর্ট হোক বা নাচ বা ফিটনেস, টোটা রায়চৌধুরী বরাবরই ফার্স্ট বয়। এমনকী টলিউডের বর্তমানের নায়কদেরও কয়েক গোল দিতে পারেন টোটা। টলিউডের ছবিতে টোটার সেই ডান্সিং স্কিলের ঝলক কম পাওয়া গেলেও বলিউডে রীতিমতো ঝড় তুলেছেন নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই বাঙালি অভিনেতা। করণ জোহরের ছবিতে দুর্গাপুজোর একটি সিকোয়েন্সে রণবীর সিংয়ের সঙ্গে 'ডোলা রে ডোলা রে' গানে কত্থক নাচেন টোটা। যা দেখে মুগ্ধ পরিচালক করণ জোহর, রণবীর সিং থেকে শুরু করে দর্শক। টোটার এই ডান্স রীতিমতো ভাইরাল। আর এই নিয়েই bangla.aajtak.in-এর কাছে টোটা জানালের তাঁর কত্থক ডান্স প্রস্তুতির কথা।
তোমার কত্থক ডান্স তো এখন রীতিমতো ভাইরাল, ভেবেছিলে কখনও এটা হবে?
টোটা রায়চৌধুরী: এই ছবির শ্যুটিং যখন শুরু করেছিলাম তখন একেবারেই ভাবতে পারিনি যে এই জায়গায় জিনিসটা যাবে। এইরকম ভাইরাল হবে, মানুষ যে আপ্লুত হয়ে যাবে, সারা ভারতবর্ষে তথা বিশ্বে প্রবাসী ভারতীয়রা যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কাছে এই সিক্যুয়েন্সটা খুবই ভালো লেগেছে এবং এটা পৌরুষের নতুন প্রতীক হিসাবে দেখা হচ্ছে, এরকম সব বলা হচ্ছে এই ডান্সটা নিয়ে। এটা কোনও মতেই আমরা কল্পনা করতে পারিনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল যে নাচটা যেন পারফেক্টলি করতে পারি, নিখুঁতভাবে যেন করতে পারি যেটুকু করেছি, যেভাবে করছি ভালোভাবে যেন করতে পারি। আর মনে তো একটা ভয় ছিল কারণ এটা আইকনিক একটা সিক্যুয়েন্স, যেখানে সঞ্জয় লীলা বনসালি স্যারের দেবদাসের মতো সবচেয়ে বড় হিট একটা ছবি, একটা আইকনিক সিক্যুয়েন্স যেখানে মাধুরী ও ঐশ্বর্য দুজন নেচেছেন। যাঁদের আমাদের ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা নৃত্যশিল্পী হিসাবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে এটা নিয়ে মনের ভেতর প্রথম থেকেই একটা শঙ্কা ছিল যে এটা যেন হাসির খোরাক না হয়ে দাঁড়ায়। রণবীরও (রণবীর সিং) অসম্ভব পরিশ্রমী, অসম্ভব প্রতিভাবান, ওঁর সঙ্গে নাচ করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই জিনিসগুলো মাথায় ছিল বলে, এটা কোথায় যাবে, কী হবে ধারণা করতে পারিনি। এখন যে কারণে এই বিষয়টা বুঝতে পারছি এখন ভালো লাগছে।
সময় তো খুব কম ছিল, কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলে?
টোটা রায়চৌধুরী: সময় সত্যিই খুব কম ছিল, আমার কাছে সময় একদমই কম ছিল। কিন্তু প্র্যাকটিস আমি শুরু করে দিয়েছিলাম। চারমাসের মতো কত্থক অভ্যাস করেছিলাম। ৪০টার মতো সেশন ছিল। কলকাতায় পারমিতা মৈত্রর কাছে শিখেছিলাম, এখানে শর্ট বেসিক কোর্সটা করেছিলাম। এরপর মুম্বইয়ের কত্থক নৃত্যশিল্পী নিকিতা বনওয়ালিকর বলে একজনের কাছে কোরিওগ্রাফের স্টেপগুলো শিখেছিলাম, এই ডান্সের কোরিওগ্রাফার ছিলেন বৈভবী মার্চেন্ট। তিনি যেহেতু কত্থকে পারদর্শী, তাই তিনি বলে দিয়েছিলেন এটা এভাবেই হবে। আমার ট্রেনিংটা খুব ভালোভাবে হয়েছিল, সে পারমিতা দি হোক, নিকিতা বনওয়ালিকর হোক বা বৈভাবী মার্চেন্ট হোক, আমাকে খুব সুন্দরভাবে তাঁরা শিখিয়ে ছিলেন। কিন্তু সময় খুব শর্ট ছিল বলে, আমি রিহার্সাল যেমন করতাম, বাড়িতে এসে প্র্যাকটিস করতাম। স্টেপ তোলার ক্ষেত্রে যেটা কঠিন সেটা হল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, মুদ্রা, শরীরী ভাষাকে রপ্ত করা সেটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার কাছে। সেটা ঠাকুরের আশীর্বাদে হয়ে গিয়েছে।
রকি-রানিতে তোমার অভিনয় দারুণ প্রশংসা পাচ্ছে, কেমন লাগছে?
টোটা রায়চৌধুরী: দেখো, বলার মতো এটাই যে এটা আমাদের টিমের একটা সাফল্য। আর যার সাফল্য সে হচ্ছে করণ জোহর। এটা করণ স্যারের কামব্যাক ফিল্ম, সাত বছর পর করণ স্যার রকি-রানি দিয়ে কামব্যাক করেছেন, আর বলে না যে চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়নই হয় এবং আর্টিস্ট আর্টিস্টই থাকেন। সেরকমই করণ জোহর সাত বছর পর ফিরলেও তাঁর কাজ একই আছে আর তিনি আরও অন্যান্য জায়গাতেও নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। আর সবাই এক কথায় বলেছেন যে এটা পরিচালকের সেরা কাজ। এটা আসলে তাঁর জয় এবং খুব সুন্দর স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে। যে তিনজন স্ক্রিপ্ট লিখেছেন শশাঙ্ক খৈতান, ঈশিতা মৈত্র ও সুমিয় রয়। এই তিনজন মিলে খুব সুন্দর স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। রণবীর-আলিয়া, জয়াজি, শাবানাজি, ধর্মেন্দ্র জি এঁরা তো আছেনই। যদি বল তো এটা সমগ্র টিমের জয়। আমরা টিম হিসাবে গত ২ বছর ধরে এই ছবিটার শ্যুট করেছি। মাঝখানে লকডাউন হয়েছে, শ্যুটিং পিছিয়েছে, তাই বছর দুয়েক ধরে এই ছবির শ্যুটিং, তারপর থেকে আমরা একটা টিম হিসাবে নিজেদেরকে অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। এটা একটা দলগত প্রয়াস বলতে পার। সেক্ষেত্রে ছবির সাফল্য মানে দলের সাফল্য। এটাই সবচেয়ে ভালো লাগছে।
অ্যাকশন হিরো থেকে ফেলুদার মগজাস্ত্র, তারপর রকি-রানিতে ডোলা রে, যা এখন ভাইরাল, কেমন লাগছে?
টোটা রায়চৌধুরী: অভিনেতার কাজই হল বিভিন্ন চরিত্রে প্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করা। এরকম চরিত্রে আমাকে তো কেউ ভাবেনি, কেউ ভাবতেই পারেনি। করণ স্যার ভেবেছিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম করণ স্যারকে যে আপনি নিশ্চিত আমাকে এই চরিত্রে আপনি নেবেন, আমি কি পারব। তখন করণ স্যার বলেছিলেন তাঁর বিশ্বাস রয়েছে আমার ওপর যে আমি এই কাজটা পারব, উনি আমার অন্যান্য কাজও দেখেছেন। করণ স্যার বলেন যে তিনি যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন তাহলে আমি কেন নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। পরিচালকের যখন আমার ওপর বিশ্বাস রয়েছে, সেটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা। দেখো আমি তো পরিচালকের অভিনেতা, তাই আমার কাছে পরিচালকের বিশ্বাস সবচেয়ে বড় জিনিস একটা ছবিতে কাজ করার ক্ষেত্রে। ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন আমাকে চোখের বালিতে বিহারির চরিত্রে ভেবেছিলেন, তখন অনেকেই তাঁকে মানা করেছিল। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল আমার ওপর। সৃজিত মুখোপাধ্যায় যখন আমাকে ফেলুদা হিসাবে ভেবেছিলেন তখন অনেকেই ভেবেছিল এ কী ফেলুদা করবে। আমি সেই বিশ্বাস রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। এখানেও তাই। পরিচালকের বিশ্বাসটা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই করণ স্যারের বিশ্বাসের ওপর ভর করে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে আর তার জেরেই আমি এটাকে ঠিক মতো করতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়।
নিজের গল্প বলেছেন করণ জোহর তোমার চরিত্র চন্দন চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে, এটা কী তোমার জানা ছিল?
টোটা রায়চৌধুরী: এটা আমাকে উনি বলেননি, একদিকে ভালোই করেছেন বলেননি। কারণ বললে হয়ত তখন আমার একটা প্রবণতা থাকত যে করণ স্যারকে অনুকরণ করার। এটা স্বাভাবিকভাবে হয়ে যায়। কিন্তু আমাকে সেটা বলেনি ভালো করেছে। বুদ্ধিমান তো উনি, আর অভিজ্ঞ। উনি চেয়েছিলেন আমি আমার মতো করে করি। তোমরাও যখন জেনেছ আমিও তখনই এটা জেনেছি। এই ধরনের ঘটনা ওঁনার সঙ্গেও ঘটেছিল। আমার কাছে এটা ছিল যে আর্টফর্ম নিয়ে যাঁরা যাঁরাই কাজ করেন, ট্র্যাডিশনাল যে প্রফেশন, সমাজ বলে যে পেশাগুলো পুরুষের নেওয়া উচিত, সেই পেশা থেকে বেরিয়ে পুরুষ যদি অন্য কোনও পেশায় যায়, যেটা বিশেষ করে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, এদেরকে অনেক কথা শুনতে হয়। সেটা নাচ বল, সঙ্গীত বল, অঙ্কন বল, পোশাক ডিজাইনিং বল, মেকআপ শিল্পী বল, পুরুষরা যখনই একটু অন্য ক্ষেত্রে যায়, তখন তাকে কথা শুনতে হয়। আমি নিজে যেহেতু এই আর্ট ফর্মের সঙ্গে যুক্ত, আমি জানি এই ধরনের মানুষকে কথা শুনতে হয়, এই ব্যথা-বেদনার সঙ্গে আমি অবগত। যে পুরুষেরা ক্ল্যাসিকাল ডান্স করেন, তাদের বাড়ির লোকের সায় ছিল না সমাজের সায় ছিল না, সেটা মাথার ভেতর সবসময় ছিল।