'মহারাজ মূর্তি কার সেটা জানা দরকার...'
'মূর্তি আমার...'
জন্মদিনে যে মানুষটি সম্পর্কে লিখতে বসা তাঁকে কয়েকটি পৃষ্ঠায় ধরানো কোনও লেখকের কম্মো নয়। এমন কোনও ফিল্মবোদ্ধা জন্মাননি যিনি তুলায় মেপে তাঁর গুণাগুণ সঠিক ভাবে ব্যাখা করতে পারেন। কাছাকাছিও যদি পৌঁছানো যায় তবে সেটা কম কিছু হবে না। আমি সে চেষ্টাও করব না। এত বড় ধৃষ্টতা আমার নেই। ভাবা যায়, এত বড় মাপের একজন প্রতিভার কোনও মূর্তি নেই শহরে! থাকলেও আজকের দিনে তাতে ঢেলা ছুঁড়ে মারা হত কিনা তা অবশ্য জানা নেই।
নাট্যকার, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পরিচালক, এক নিঃশ্বাসে বলা সম্ভব নয় এমন আরও বহুগুণী প্রতিভা ছিলেন উৎপল দত্ত। ১৯২৯ সালে ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্ম। তবে তাঁর জন্মস্থান নিয়ে কিছুটা ধন্দ রয়েছে। তিনি নিজে কয়েকবার বলেছেন, তাঁর জন্ম মামারবাড়ি শিলংয়ে। আবার অন্যান্য নানা তথ্য বরিশালের তত্ত্বে সিলমোহর দেয়। আজ তাঁর জীবনের একটি অধ্যায় নিয়েই আলোচনার সামান্য চেষ্টা করছি।
সিনেমায় উৎপল দত্ত বিরাট মহীরূহ। বাংলা হোক বা হিন্দি, তিনি যে সব চরিত্রকে অনায়াস ভঙ্গিতে স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলেছেন তা উৎপল দত্ত ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব হত বলে মনে করি না। কৌতুক, নেগেটিভ, পার্শ্বচরিত্র, সব জায়গায় অবাধ গতি। কোনও একটি ধারায় তাঁকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। শতধারায় ভারতীয় সিনেমাকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়কে স্যর বলে ডাকতেন। অসীম শ্রদ্ধা ছিল মানুষটির প্রতি। একই ভাবে সত্যজিৎ রায়ও এমন বিরল প্রতিভার যোগ্য সদ্ব্যবহার করে গিয়েছেন তাঁর কয়েকটি সিনেমায়। জন অরণ্য, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে এবং আগন্তুক। সত্যজিৎ একাধিক জায়গায় বলেছিলেন, 'উৎপল রাজি না হলে আমি আগন্তুক তৈরি করতাম না।' এই প্রটাগনিস্টের মুখ দিয়ে সত্যজিৎ নিজের ভাবনা-চিন্তা প্রকাশ করে গিয়েছেন। উৎপল দত্ত ছাড়া মনোমোহন মিত্র আর কারও পক্ষে করা সম্ভব হত না। এটা শুধুমাত্র আমার নয়, সত্যজিৎ রায়েরও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
নিজেকে প্রোপাগান্ডিস্ট বলতে পছন্দ করতেন উৎপল দত্ত। অভিনয় তাঁর নেশা এবং পেশা। তিনি বলতেন, 'পেটের জন্য সিনেমা করি আর নিজের জন্য নাটক-যাত্রা।' প্রকৃত পক্ষে নাটককে মন থেকে ভালোবাসতেন উৎপল দত্ত। সেই নাটকই তাঁকে জেলে ঢুকিয়েছিল। ১৯৬৫ সালে কল্লোল নাটক মঞ্চস্থ করার 'অপরাধে' ৭ মাস জেল খাটতে হয় উৎপল দত্তকে। নাটকের বিষয়বস্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের ছিল না পসন্দ। ১৯৪৬ সালের নৌবিদ্রোহ নিয়ে লেখা একটি নিষিদ্ধ বই অবলম্বনে কল্লোল নাটক লেখেন তিনি। নাটক যে হতে চলেছে তার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল সংবাদপত্র। কিন্তু তৎকালীন কোনও সংবাদপত্র সেই বিজ্ঞাপন ছাপেনি। তবে উৎপল দত্তের এমনই আকর্ষণ ছিল যে হল কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। গ্রেফতারি এড়াতে কিছু আত্মগোপন করেও থাকেন তিনি। তবে অবশেষে ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার তাঁকে হতে হয়। তবে ঘটনার পর থেকেই ক্রমশ উৎপল দত্তের মুক্তির দাবিতে বাংলার সাংস্কৃতিক জগৎ সোচ্চার হতে থাকে। সভা-মিছিল সামলাতে পুলিশের অবস্থা শোচনীয়। ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ তাঁর মুক্তির দাবিতে বিরাট মিছিলের আয়োজন করা হয়। খাদ্য আন্দোলনে জেরবার রাজ্য সরকার ঠিকই করে নিয়েছিল, মিছিল আটকাতে প্রয়োজন হলে গুলি চালানো হবে। কিন্তু সেই মিছিলে সকলের সামনে হাঁটছিলেন সত্যজিৎ রায়, মন্মথ রায় , মধু বসু প্রমুখরা। পুলিশের আর সাহস হয়নি সে মিছিলে গুলি চালানোর। প্রবল চাপের মুখে বাধ্য হয়ে উৎপল দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।
সম্ভবত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কারণেই তাঁর ঝুলিতে মাত্র ১টি জাতীয় পুরস্কার। হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। সত্যজিৎ রায় মনে করতেন, যদি উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্তর মতো প্রতিভা বিদেশে জন্মাতেন, তা হলে তাঁরা অস্কার পেতেন। একেবারেই অতিশয়োক্তি নয়। পুরস্কারের গণ্ডিতে তাঁর মতো অভিনেতাকে বাঁধতে চাওয়া মুর্খামির নামান্তর। তিনি যে স্তরের অভিনেতা ছিলেন, তাঁর প্রতিভাকে জাজ করে নম্বরের ঘরে সংখ্যা বসানোর মতো লোক তখন গোটা দেশে হাতে গোণা যাবে। ফলে তিনি পুরস্কার পেলেন কী পেলেন না, সেটা এখানে অবান্তর বিষয়। তবে একটি বিষয়কে এখানে ধরতেই হবে, তা হল সরকারের আনুগত্য। ওই জিনিসটি একেবারেই ধাতে ছিল না তাঁর। ব্রেখট-এর ভক্ত উৎপল অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়ে নিজের বিবেকের কাছে সব সময় জবাবদিহি করে গিয়েছেন, সোচ্চারে বলেছেন তিনি সমাজতান্ত্রিক বামপন্থী। তার জন্য যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন। মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ঠাট্টা করে বলতেন, 'ষাট বছর বয়স হলে বিপ্লবী আর বিপ্লবী থাকে না, প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়।'
১৯৯৩ সালে আচমকা তাঁর চলে যাওয়া সেই প্রতিক্রিয়ায় ছেদ ঘটায়। মাত্র ৪ বছরই প্রতিক্রিয়াশীল থাকতে পেরেছেন উৎপল দত্ত। একটা সময় বামপন্থী দলগুলির সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব বেড়েছিল। কিন্তু তিনি কখনও বলেন, দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না! আদর্শের পরিভাষা সত্যিই পাল্টে গিয়েছে।