যে মানুষটা একদিন একটি সাধারণ মেয়ের মনে লড়াইয়ের স্পার্ক জাগিয়েছিলেন, আজ তাঁর জীবনযুদ্ধ শেষ। দীর্ঘ ৪০ দিন জীবনের সঙ্গে লড়াই করছিলেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। রবিবার বেলা ১২.১৫ মিনিটে প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chattopadhay)।
সেদিনের সেই সাধারণ মেয়েটি আজ প্রতিষ্ঠিত। তাই, জীবনের স্পার্ক এনে দেওয়া মানুষটার এই অবস্থা দেখে আজ মন ভালো নেই তাঁর। তিনি কোনি। রিল লাইফের কোনি থেকে আজ প্রতিষ্ঠিত শ্রীপর্ণা ব্যানার্জী। আর যেই মানুষটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েছিলেন এতদিন, তিনি তাঁর 'ক্ষীদ দা'। কোনির ক্ষীদ দা, ওরফে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গত ৬ অক্টোবর থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ক্রমেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি উদ্বেগ বাড়িয়েছিল সকলের। এবার সব উদ্বেগের অবসান। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন 'ক্ষীদ দা'।
মতি নন্দীর লেখা কোনি সিলভার স্ক্রিনে মুক্তি পায় সরোজ দে'র হাত ধরে ১৯৮৪ সালে। ছবিটি জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত। সেখানে এক অভাবী পরিবারের মেয়ে কোনি (শ্রীপর্ণা ব্যানার্জী)। চোখ ভড়া স্বপ্ন জাতীয় স্তরের সাতারু হবে। কিন্তু, আর্থিক অনটনের জন্য যখন স্বপ্ন ভেঙে যেতে বসেছিল, ঠিক তখনই তাঁর জীবনে স্পার্কের মতো হাজির হন ক্ষীদ দা। ক্ষিতীশ সিংহ (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। সংসারের প্রায় সর্বস্ব নিশ্বেস করে কোনিকে জাতীয় স্তররের সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি করেন তিনি। কোনির চোখ ভরা স্বপ্ন, আর ক্ষীদ দা'র কঠোর শাসন, তৈরি করেছিল ইতিহাস। প্রতিযোগিতার শেষ লব্ধে দেশের সেরা সাঁতারুদের সঙ্গে লড়ছে কোনি, আর ক্ষীদ দা'র সেদিনের চিৎকার "ফাইট, কোনি ফাইট! ফাইট..."। সেদিনের যুদ্ধে জিতেছিল রিল লাইফের কোনি।
আজ সেই কোনির ক্ষীদ দা এবার পরাজিত। প্রতিযোগিতা নয়, জীবন যুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আর শেষ রক্ষা হল না। তাই কোনিরও মন ভালো নেই। কিছু দিন আজতক বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাস্তরের কোনি অর্থাৎ শ্রীপর্ণা ব্যানার্জী বলেছিলেন, "সেদিনের মতো আমি যদি ক্ষীদ দা-কে কানের কাছে গিয়ে আজ বলতে পারতাম ফাইট, ক্ষীদ দা ফাইট! ফাইট..., তাহলে হয়তো আমার কথা ফেলতে পারতেন না। তাঁকে লড়তেই হবে। তিনি লড়বেনই।" তিনি আরও বলেছিলেন, "প্রতি মুহুর্তে আমার কেবল ওনার কথা মনে পড়ছে। জীবনে লড়াই করা আমি ওনার থেকেই শিখেছি। যেদিন থেকে ওনার অসুস্থতার কথা জেনেছি মন ভীষণ খারাপ। বার বার ওনার মেয়ের দেওয়া আপডেট দেখছি। উনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন এটাই চাইছি"। প্রায় ৩৬ বছরের পুরানো স্মৃতিচারণ করে শ্রীপর্ণার কথায়, " আমাদের যিনি কোচ ছিলেন অনিলদা, আমার বারবার মনে হতো 'ক্ষীদ দা' বোধহয় তাঁর ওপরই লেখা। সৌমিত্র বাবু আমার মুখে সেই কথা শুনে আমাদের যখন ট্রেনিং হত ভোর ৫.৩০ - ৬ টায় এসে এক কোনায় বসে থাকতেন অনিল দা'র মুভমেন্ট দেখার জন্য। চরিত্রের স্বার্থে এটা সৌমিত্র বাবুর মতো একজন শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। প্রয়োজনে সব বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া, এটাই আমি ওনার থেকে শিখেছি। এখনও ওনার নাটক দেখতে গেলে গ্ৰিন রুমে গিয়ে দেখা করি। আমায় চিন্তে পেরে জড়িয়ে ধরেন ।"
প্রসঙ্গত কলকাতা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা শ্রীপর্ণা ব্যানার্জী জানালেন, তিনি আর অভিনয়ে ফিরতে চান না। বললেন, আমরা যখন যে কাজটা করি সেটাতেই সম্পূর্ণ উৎসর্গ করা উচিত, এটাও আমি সৌমিত্র বাবুর থেকেই শিখেছি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই আরও খারাপের দিকে এগোচ্ছিল। চিকিত্সায় সাড়া দিচ্ছিলেন না তিনি। গত ১৩ নভেম্বর বেলভিউ সূত্রে খবর অনুযায়ী, মস্তিষ্ক প্রায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল তাঁর। কাজ করছিল না হার্টও। চিকিৎসকদের শত চেষ্টাতেও সৌমিত্র সাড়া দিচ্ছিলেন না চিকিৎসায়।
চিকিৎসকদের বয়ান অনুযায়ী, কেবল হার্ট নয়, কিডনির অবস্থাও বিশেষ ভাল ছিল না ফেলুদার। প্রথমবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল আলাদা যন্ত্রের ব্যবহারে। গত ১২ নভেম্বর তাঁর প্লাজমাফেরেসিস সফলভাবে হওয়ার পর অবস্থা স্থিতিশীলই ছিল। কিন্তু পরের দিন হঠাৎ অনিয়মিত হয়ে পড়ে হৃদস্পন্দন। সৌমিত্রের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান চিকিৎসক অরিন্দম কর জানিয়েছিলেন, অভিনেতার মস্তিষ্কের স্নায়ুর সচেতনতা অর্থাৎ গ্লাসগো কোমা স্কেল প্রায় ৫-এ এসে দাঁড়িয়েছিলন সেদিন তাঁর।
অরিন্দম কর জানান, ওনার ডায়ালিসিস হচ্ছে। এই প্রথমবার আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার। বুধবার সৌমিত্র বাবুর ট্রাকিওস্টোমি সফলভাবেই হয়েছিল। অবস্থা স্থিতিশীলই ছিল কিন্তু হঠাৎ এই অবনতিতে চিন্তায় চিকিৎসকেরা। ডাঃ কর এদিন আরও জানিয়েছেন "ওঁনার ডায়ালিসিস হচ্ছে। এই প্রথমবার আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার।" গত ১১ নভেম্বর বর্ষীয়ান অভিনেতার ট্রাকিওস্টোমি সফলভাবেই হয়েছিল। অবস্থা স্থিতিশীলই ছিল কিন্তু হঠাৎ এই অবনতি হওয়ায় আশঙ্কায় ছিলেন চিকিৎসকেরা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে অবসান হল একটা যুগের। বর্ষীয়ান অভিনেতার জীবনাবসানে শোকস্তব্ধ গোটা শিল্পীমহল থেকে তাঁর অসংখ্য অনুগামীরা।