26/11 Mumbai: ভারতে '২৬ নভেম্বর ২০০৮' এমনই একটি তারিখ যা মনে পড়লেই সবার মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের কালো ছায়া চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই তারিখেই প্রতি বছর যেন দেশের বাণিজ্য নগরী মুম্বইয়ের সেই পুরনো ক্ষত টনটন করে ওঠে। ১৫ বছর আগে এই দিনেই, মুম্বই বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হয়।
লস্কর-ই-তৈয়বার ১০ জন সন্ত্রাসবাদী এই হামলা চালায়। তাদের এর আগে পাকিস্তানে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। অত্যাধুনিক অস্ত্র, খাবারদাবার নিয়ে তারা একটি নৌকায় করে সমুদ্রপথে মুম্বইয়ে প্রবেশ করেছিল। আর তারপর শহরজুড়ে তাদের সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুরতার চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। জনবহুল স্থান এবং বিল্ডিং ছিল তাদের টার্গেট। এই হানা এবং তাদের হত্যালীলা চলে চার দিন ধরে।
মুম্বইয়ের 26/11-র সেই রাত
সন্ত্রাসবাদী হামলায় ১৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ২০০ জনেরও বেশি আহত হন। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে মুম্বইতে সবকিছু স্বাভাবিকই চলছিল। হঠাৎ করেই পুরো শহর জুড়ে বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মুম্বইয়ে যে এত বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে কারও ধারণাই ছিল না। রাত ১০টার দিকে খবর আসে যে বরিবন্দরে একটি ট্যাক্সিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, যাতে চালক ও দুই যাত্রী প্রাণ হারিয়েছে।
এর প্রায় ২০ মিনিট পরে খবর আসে যে, ভিলে পার্লে এলাকায় একটি টাক্সি বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এর ফলে চালক এবং একজন যাত্রী নিহত হয়েছে। এই দুই হামলায় প্রায় ১৫ জন আহত হন। এর পরে, মুম্বইয়ের বেশ কিছু জায়গায় গুলি চালানোর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। আর তখনই মুম্বই পুলিশ এবং গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন যে এটি একটি বড়, পরিকল্পিত সন্ত্রাসবাদী হামলা। হামলাকারীরা মুম্বইয়ের দুটি পাঁচতারা হোটেল, ওবেরয় ট্রাইডেন্ট এবং তাজ, ছত্রপতি শিবাজি রেলওয়ে স্টেশন, নরিমান হাউস ইহুদি কেন্দ্র, লিওপোল্ড ক্যাফে এবং কামা হাসপাতালকে টার্গেট করে।
সন্ত্রাসবাদীরা তাজ ও ওবেরয়ে প্রবেশ করে
সেই রাতে তাজ হোটেলে ৪৫০ জন এবং ওবেরয় ট্রাইডেন্টে ৩৪০ জন ছিলেন। আর সেই সময়েই সন্ত্রাসবাদীরা এই দুই জায়গায় আক্রমণ করেছিলেন। তাজ হোটেলের গম্বুজ থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। পরে সেটাই হয়ে ওঠে মুম্বই সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রতীক ছবি। লিওপোল্ড ক্যাফেতে দুই সন্ত্রাসবাদী নির্বিচারে গুলি চালায়। এখানে প্রায় ১০ জনের মৃত্যু হয়। এই ক্যাফেটি ১৮৮৭ সাল থেকে চলছে। বেশিরভাগই বিদেশী অতিথিরা এখানে আসেন। আজমল আমির কাসাব এবং ইসমাইল খান সিএসএমটি স্টেশনে গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত ছিল। এতে ৫৮ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন।
মুম্বইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে চার হামলাকারী পুলিশের একটি ভ্যান ছিনতাই করে কামা হাসপাতালে প্রবেশ করে। মুম্বই ATS প্রধান হেমন্ত কারকারে, মুম্বই পুলিশের অশোক কামতে এবং বিজয় সালাসকার হাসপাতালের বাইরে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। সেই রাতেই, একটি স্কোডা গাড়ি ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময়, সাব ইন্সপেক্টর তুকারাম ওম্বলে আমির আজমল কাসাবকে জীবিত ধরেন এবং তার সঙ্গে থাকা অপর সন্ত্রাসবাদী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। তবে কাসাবকে ধরার সময়ে সে তুকারামকে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বীর পুলিশ আধিকারিকের।
৪ দিন ধরে চলে অপারেশন
মুম্বই সন্ত্রাসবাদী হামলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাজ হোটেল এবং ওবেরয় ট্রাইডেন্টে আটকে পড়া মানুষদের এবং সেখানে উপস্থিত সন্ত্রাসবাদীদের হাতে আটক ব্যক্তিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর জন্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড অর্থাৎ NSG-র কমান্ডোরা দায়িত্ব নেন। ওবেরয় হোটেলে, এনএসজি উভয় সন্ত্রাসবাদীকে হত্যা করে এবং সমস্ত আটককে উদ্ধার করে। তবে তাজ হোটেলে অভিযান দীর্ঘ সময় ধরে চলে। ৪ সন্ত্রাসী তাজে ঢুকে ৩১ জনকে গুলি করে। হোটেলের একটি অংশে তারা বহু মানুষকে আটকে রেখেছিল। হোটেলে অপারেশন চলাকালীন মেজর সন্দীপ উন্নীকৃষ্ণান শহীদ হন। ২৯ নভেম্বর সকালের মধ্যে, এনএসজি চার সন্ত্রাসবাদীকে হত্যা করে এবং 'জিম্মি'দের উদ্ধার করে।
মাস্টারমাইন্ড এখনও জীবিত
২৬/১১ মুম্বই সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত ৯ সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়। একমাত্র আমির আজমল কাসব জীবিত ধরা পড়ে। কাসবের বিচার হয়, আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২১ নভেম্বর ২০১২-এ পুনের ইয়েরওয়াদা জেলে সকাল সাড়ে ৭টায় তার ফাঁসি হয়। কিন্তু এই ১০ সন্ত্রাসবাদীই যে এই হামলায় জড়িত ছিল, তা নয়। তাদের হ্যান্ডেলাররা বসে ছিল পাকিস্তানে। হাফিজ সাইদ এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। জাইবুদ্দিন আনসারি ওরফে আবু জান্দাল পাকিস্তানে বসে মুম্বইয়ে আসা ১০ সন্ত্রাসীকে পরিচালনা করছিল। তাহাওউর রানা অস্ত্রের ব্যবস্থা করেছিল। তারা সবাই এখনও জীবিত। রানা বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী এবং ভারত তাকে হেফাজতে নেওয়ার চেষ্টা করছে।