
দিল্লি থেকে রাজস্থান। উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে দাঁড়িয়ে আরাবল্লী। যুগ যুগ ধরে নীরবে পাহারা দিয়ে এসেছে মরু, সমতল আর সভ্যতাকে। সেই আরাবল্লী আজ বিপদের মুখে। বয়স প্রায় আড়াইশো কোটি বছর। পৃথিবীর প্রাচীনতম পর্বতশ্রেণিগুলির একটি। শুধু ভূতত্ত্ব নয়, পুরাণেও উল্লেখ আছে আরাবল্লি 'পর্বতে'র। মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণে পর্বত হিসাবে আরাবল্লির উল্লেখ রয়েছে। এই স্থান তপোভূমি ও ঋষিদের আশ্রমভূমি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে পুরাণে। লোককথায় শোনা যায়, আরাবল্লিই নাকি বিন্ধ্য পর্বতের ঔদ্ধত্য ঠেকাতে দেবতাদের আশীর্বাদ পেয়েছিল। সেই পৌরাণিক পাহাড় আজ মানুষের লোভের কাছে অসহায়। মানুষের হাতে ক্ষয়ে যেতে যেতে সেই আরাবল্লিই কি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে?
আরাবল্লি ঘিরে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। কেন্দ্রের আরাবল্লিতে খননের প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ ছড়াতেই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বিষয়টি গ্রহণ করেছে শীর্ষ আদালত। আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, গত ২০ নভেম্বরের নির্দেশ আপাতত কার্যকর করা হবে না। আগামী শুনানি ২১ জানুয়ারি ২০২৬। তত দিন পর্যন্ত স্থগিত থাকবে সংশ্লিষ্ট নির্দেশ। পাহাড়ের পাদদেশে খনন, নির্মাণ ও রিয়েল এস্টেট প্রকল্প ঘিরে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, আদালতের এই অবস্থানে তা আপাতত খানিকটা থামলেও, বাস্তব চিত্র ভয় ধরাচ্ছে পরিবেশবিদদের।
কারণ আরাবল্লি কার্যত এমনিতেই ধ্বংসের মুখে। শুধু খনন নয়, নগরায়ন, চাষবাস আর বসতি বিস্তারের চাপে ক্ষয়ে যাচ্ছে এই পাহাড়। রাজস্থানের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির গবেষকদের করা এক সমীক্ষা বলছে, ২০৫৯ সালের মধ্যে আরাবল্লির ১৬,৩৬০ বর্গকিলোমিটারের বেশি বনভূমি জনবসতিতে পরিণত হতে পারে। অর্থাৎ, এক মানবজীবনের মধ্যেই উধাও হয়ে যেতে পারে পাহাড়ের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ গাছ।
৪৪ বছরের স্যাটেলাইট ডেটা, ১৯৭৫ থেকে ২০১৯, এই দীর্ঘ সময়ের ছবিকে Google Earth Engine ও আধুনিক মেশিন লার্নিং মডেলে ফেলে দেখা হয়েছে। গবেষক অলোক রাজ ও অধ্যাপক লক্ষ্মীকান্ত শর্মা দেখিয়েছেন, কী ভাবে ধাপে ধাপে বদলে যাচ্ছে আরাবল্লির ভূমিচিত্র। তথ্য বলছে, এই সময়কালে প্রায় ৫,৭৭৩ বর্গকিলোমিটার জঙ্গল হারিয়েছে আরাবল্লি। তার বড় অংশই পরিণত হয়েছে অনুর্বর জমি ও মানববসতিতে।
ভবিষ্যৎ চিত্র আরও উদ্বেগজনক। গবেষণার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫৯ সালের মধ্যে বনভূমির প্রায় ২১.৬ শতাংশ সরাসরি বসতিতে রূপান্তরিত হবে। দিল্লি-এনসিআর থেকে শুরু করে উদয়পুর, সিরোহি; রাস্তা, শিল্পাঞ্চল ও শহরের বিস্তারের ফলে পাহাড়কে কেটে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। এক সময়ের অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক করিডর এখন দ্বিখণ্ডিত।
এই ক্ষয় শুধু পাহাড়ের নয়। আরাবল্লি জলাধার রিচার্জ করে, ধুলোঝড় ঠেকায়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, জীববৈচিত্র্যের আশ্রয় দেয়। সেই ঢাল ভেঙে গেলে তার প্রভাব পড়বে রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি ও গুজরাত; চার রাজ্যের জীবনযাত্রায়। গবেষকদের মতে, বনভূমি কমলে জলসংকট, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জীবিকার উপর চাপ অনিবার্য।
গবেষকরা বলছেন, এই মডেল কেবল সতর্কবার্তা নয়, পরিকল্পনার হাতিয়ারও হতে পারে। কোথায় বন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, তা চিহ্নিত করে সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধারের সুযোগ এখনও আছে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, নীতি ও প্রয়োগে কি সেই সদিচ্ছা থাকবে?
ভারতের প্রাচীনতম পাহাড়ের জন্য সময় আর হাজার বছর নয়। হাতে আছে মাত্র চার দশক। আরাবল্লি বাঁচবে কি না, তার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আজকের সিদ্ধান্তেই।