বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক দিক থেকে চিরকালই সংবেদনশীল ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন পালাবদল শুরু হয়েছে। এই পালাবদলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ইঙ্গিত বারবার উঠে আসছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান রাওয়ালপিন্ডি সফর করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান অসীম মুনির তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সূত্রের খবর। এটি সামরিক এবং গোয়েন্দা সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এক প্রতিনিধিদল সম্প্রতি ঢাকায় সফর করেছে। এ দলে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শহীদ আমির আফসার, ব্রিগেডিয়ার আলম আমির আওয়ান এবং ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মদ উসমান জাতিফ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ কয়েক দশক পর এই ধরনের উচ্চপর্যায়ের সফর ঘটে। যদিও এ বৈঠকের আলোচ্যসূচি প্রকাশ করা হয়নি, তবে সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের ভেতর আইএসআই-এর তৎপরতা
আইএসআই এবং বাংলাদেশের জামায়াত-উল-মুজাহিদিন (জেএমবি) গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ার সম্ভাবনা ভারতের জন্য উদ্বেগজনক। ইউনূস সরকারের সময়ে অনেক কট্টরপন্থী নেতার মুক্তি এবং মৌলবাদী কার্যকলাপ বাড়ানোর খবর ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
জেএমবি ইতিমধ্যেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। সেখানে যুবকদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভারতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। আইএসআই এই গোষ্ঠীগুলিকে আরও সক্রিয় করতে পারে এবং ভারতের বিরুদ্ধে তাদের উসকানি দিতে পারে।
সীমান্ত সমস্যায় নতুন মাত্রা
ভারত ও বাংলাদেশের ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইএসআই-এর তৎপরতা এই সমস্যাকে আরও বাড়াতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৌশলগত সমীকরণ
পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা অবনতির দিকে গেলেও, ভূগোল ও অর্থনীতির বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশ সরাসরি ভারতবিরোধী অবস্থান নিতে পারবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
ভারতের জন্য করণীয়
১. সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার: বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়ানো এবং চোরাচালান বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
২. কূটনৈতিক প্রচেষ্টা: বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়ানো এবং আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
৩. গোয়েন্দা সহযোগিতা: বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইএসআই ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা।
৪. অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন: বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক সুদৃঢ় করা।