
ঢাকা পুলিশের দাবি উড়িয়ে দিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদির খুনে অভিযুক্তরা নাকি বাংলাদেশ ছেড়ে মেঘালয় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়েছে; এই অভিযোগের সঙ্গে কোনও বাস্তব প্রমাণ নেই বলেই স্পষ্ট জানাল বিএসএফ। রবিবার মেঘালয়ে বিএসএফের তরফে কড়া ভাষায় জানানো হয়েছে, এমন কোনও সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা তাদের নজরে আসেনি। অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘ভ্রান্তিকর’ বলেই ব্যাখ্যা করেছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
মেঘালয়ে বিএসএফের আইজি ওপি উপাধ্যায় স্পষ্ট বলেন, 'এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হালুয়াঘাট সেক্টর দিয়ে কেউ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ে ঢুকেছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। বিএসএফ এমন কোনও ঘটনা সনাক্ত করেনি, এমনকি এ সংক্রান্ত কোনও রিপোর্টও আমাদের কাছে নেই।' তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার, সীমান্ত নজরদারিতে কোনও ফাঁক ছিল না বলেই দাবি বাহিনীর।
এর আগেই ঢাকার মেট্রোপলিটন পুলিশের এক শীর্ষকর্তা দাবি করেছিলেন, হাদি খুনের ঘটনায় মূল দুই অভিযুক্ত নাকি ‘স্থানীয় সহযোগীদের সাহায্যে’ মেঘালয়ের গারো হিলস অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। এমনকি তিনি এটাও বলেছিলেন, অভিযুক্তদের সাহায্য করা দু’জন ব্যক্তিকে নাকি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আটক করেছে। এই মন্তব্য ঘিরেই নতুন করে বিতর্ক দানা বাঁধে।
তবে শুধু বিএসএফ নয়, ঢাকার ওই বক্তব্যকে নাকচ করেছে মেঘালয় পুলিশও। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক জানান, 'গারো হিলসে অভিযুক্তদের উপস্থিতি নিয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য ইনপুট বা গোয়েন্দা তথ্য নেই।' তাঁর কথায়, স্থানীয় থানাগুলিও কোনও সন্দেহজনক গতিবিধির খবর পায়নি। যদিও কেন্দ্রীয় সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হচ্ছে বলেই জানান তিনি।
বিএসএফের তরফে আরও জানানো হয়েছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশে চলমান অস্থির পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই সীমান্তে সতর্কতা আরও বাড়ানো হয়েছে। মেঘালয়ের পশ্চিম সেক্টরের আন্তর্জাতিক সীমান্তে সর্বক্ষণ নজরদারি চলছে। বাহিনীর দাবি, কোনও বেআইনি অনুপ্রবেশের চেষ্টা হলে তা সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে।
এদিকে ঢাকার পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তদের ফেরত আনতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। প্রত্যর্পণের বিষয়টি নিয়ে নাকি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক; দু’ধরনের চ্যানেলেই আলোচনা চলছে। তবে ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও রাজ্য পুলিশের বক্তব্যে স্পষ্ট, আপাতত সেই দাবির কোনও ভিত্তি নেই।
এই প্রসঙ্গে নতুন করে সামনে এসেছে শরিফ ওসমান হাদির রাজনৈতিক পরিচয় ও তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে বাংলাদেশের অস্থির পরিস্থিতির কথা। হাদি ছিলেন বাংলাদেশের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক মুখ। তিনি যেমন ভারতের কড়া সমালোচক ছিলেন, তেমনই আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধেও সরব ছিলেন। গত বছরের ‘জুলাই অভ্যুত্থান’; ছাত্র আন্দোলনের অভিঘাতে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর; হাদি গড়ে তুলেছিলেন নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনে লড়াইয়ের প্রস্তুতিও শুরু করেছিলেন তিনি।
১২ ডিসেম্বর ঢাকায় মুখোশধারী আততায়ীরা গুলি চালায় হাদির মাথায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হলেও ছ’দিন পর মৃত্যু হয় তাঁর। সেই মৃত্যুই নতুন করে আগুনে ঘি ঢালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে হিংসা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় প্রথম আলো, ডেইলি স্টার-এর মতো সংবাদপত্রের দফতর। রেহাই পায়নি ছায়ানট, উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও।
হিংসার আঁচ ছড়িয়ে পড়ে মধ্য বাংলাদেশেও। ময়মনসিংহে এক হিন্দু কারখানা শ্রমিককে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে সীমান্ত পেরোনো নিয়ে ঢাকার দাবি ও তার পাল্টা জবাব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। প্রশ্ন উঠছে, খুনের তদন্তে দায় এড়াতেই কি সীমান্ত পেরোনোর তত্ত্ব? নাকি অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিবেশী দেশের দিকে আঙুল তোলাই সহজ পথ? আপাতত প্রমাণের অভাবে সেই প্রশ্নই ঘুরছে সীমান্তের দু’পারে।