মুম্বই থেকে দুবাই যাওয়া যাবে ট্রেনে (Mumbai Dubai Underwater Train)। যা সমুদ্র দিয়ে যাবে। এটা কল্পনার জগতের গল্পের মতো শোনাচ্ছে? কিন্তু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটগুলিতে এই ধারণাটি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এর খরচ বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এই প্রকল্পের বাস্তবতা নিয়ে গুরুতর আলোচনা চলছে। মুম্বই থেকে দুবাই আন্ডারওয়াটার রেল প্রকল্প একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প, যা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (UAE) কোম্পানি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ব্যুরো লিমিটেড (NABL) দ্বারা প্রস্তাবিত। এটি হবে একটি হাই স্পিড রেল নেটওয়ার্ক, যা আরব সাগরের মধ্য দিয়ে ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে যুক্ত করবে।
এই ধারণাটি প্রথম ২০১৮ সালে উঠে আসে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এর আলোচনা আবার তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৫ সালে। দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স শেখ হামদান বিন মহম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম বর্তমানে ভারত সফরে রয়েছেন। বুধবার তিনি মুম্বই গিয়েছেন। সেখানে তিনি ভারত ও আমিরশাহির মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা সহ ভবিষ্যতের অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। মঙ্গলবার সংবাদপত্র খালিজ টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংবাদপত্রটি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ব্যুরো লিমিটেডের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে দুবাই-মুম্বই রেল প্রকল্পটি এখনও 'ধারণার পর্যায়ে' রয়েছে। ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ব্যুরো লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবদুল্লাহ আল শেহি খালিজ টাইমসকে জানিয়েছেন যে প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করার আগে কোম্পানিকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নিতে হবে। আর এই বিষয়ে এখনই কিছু স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
জলের নীচের রেল প্রকল্প কী?
ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ব্যুরো লিমিটেড ৬ বছর আগে আবুধাবিতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-ভারত কনক্লেভে এই প্রকল্প নিয়ে প্রথম তথ্য় দিয়েছিল। আবদুল্লাহ শেহির আঁকা এই প্রকল্পের রূপরেখা অনুসারে, হাই স্পিড ভাসমান ট্রেনের মাধ্যমে ভারতের মুম্বইকে দুবাইয়ের ফুজাইরার সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রচার করা। ফুজাইরাহ বন্দর থেকে ভারতে তেল রফতানি করা হবে এবং মুম্বইয়ের উত্তরে নর্মদা নদী থেকে অতিরিক্ত জল দুবাইতে আনা হবে। এছাড়াও, এই রুটে ট্রেন চলবে, যার মাধ্যমে যাত্রীরা মুম্বই থেকে দুবাই এবং দুবাই থেকে মুম্বই যাতায়াত করতে পারবেন।
আবদুল্লাহ আল শেহির মতে, যদি এই প্রকল্পটি সফল হয়। তবে আরও অনেক রুট নিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শহরগুলিও এর আওতায় আসবে। আল শেহি বলেন, আমরা এই অঞ্চলের প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মানুষের কথা বলছি। তাঁদের জন্য বিমানের পরিবর্তে ট্রেন ব্যবহার করা সহজ হবে।
সৌজন্যে- খালিজ টাইমস
সমুদ্রের মধ্য দিয়ে যাওয়া এই রেলপথের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার। এর গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার থেকে ১০০০ কিলোমিটার।
আল শেহির মতে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেট ব্যবহার করে ট্রেনটিকে টানেলে চালানো হবে। এটি ম্যাগলেভ প্রযুক্তি নামে পরিচিত, যা ট্রেনটিকে ১,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এইভাবে, দুবাই থেকে মুম্বই মাত্র ২ ঘণ্টায় যাওয়া যাবে। বর্তমানে, বিমানে এই যাত্রা সম্পন্ন করতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। জাপান এবং চিনে বুলেট ট্রেনগুলি কেবল ম্যাগলেভ প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলে। এই প্রযুক্তি ম্যাগনেটিক ফোর্স ব্যবহার করে ট্রেনটিকে বাতাসে তুলে ঘর্ষণ কমায়, যার ফলে ১,০০০ কিমি/ঘণ্টা গতি সম্ভব হয়। তিনি বলেন, ট্রেনটি কংক্রিটের টানেলের মধ্য দিয়ে যাবে, যা আরব সাগরের পৃষ্ঠ থেকে ২০-৩০ মিটার নীচে ডুবে থাকবে। ঢেউয়ে যাতে সরে না যায় তাই টানেলগুলি নোঙর করা হবে।
ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ব্যুরো লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আল শেহি জানিয়েছেন যে এই প্রকল্পের মাধ্যমে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনের জন্য আরব উপসাগরে ভারতের প্রবেশদ্বার হয়ে উঠবে এবং এটি সংযুক্ত আরব আমিরশাহির জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি কৌশলগত পরিবর্তন আনবে।
ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ব্যুরো লিমিটেড একটি পরামর্শদাতা সংস্থা, যা স্টার্ট-আপ এবং বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে। দুবাইয়ের জল সমস্যা সমাধানের জন্য এই কোম্পানিটি অ্যান্টার্কটিকা থেকে বরফখণ্ড টেনে দুবাইয়ের সমুদ্রে আনার প্ল্যান দিয়েছে। তারপর এই আইসবার্গ থেকে পানীয় জল তৈরি করা হবে।
পৃথিবীতে কি এমন ট্রেন চলে?
জলে নীচে রেলের ধারণা বিশ্বে নতুন নয়। কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যেই রয়েছে অথবা নির্মীয়মাণ। চ্যানেল টানেল (যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স) এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ। যা ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সকে সংযুক্ত করে। ৫০.৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সুড়ঙ্গটি ১৯৯৪ সালে খোলা হয়েছিল। এর গভীরতা ৭৫ মিটার পর্যন্ত। এতে, ইউরোস্টার ট্রেনগুলি ১৬০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে চলে। ভারত সম্প্রতি জলের নীচে মেট্রো চালু করেছে। বাংলার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। গঙ্গার নীচে ৫২০ মিটার দীর্ঘ একটি টানেল দিয়ে মেট্রো চলে। যা হাওড়া এবং কলকাতাকে যুক্ত করেছে। এটি দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো টানেল, যা হুগলি নদীর উভয় তীরে অবস্থিত দুটি শহরকে সংযুক্ত করেছে। এর জন্য ৩.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি ভূগর্ভস্থ টানেল তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫২০ মিটার গঙ্গার নীচে। এটি ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে অতিক্রম করা হয়।
দুবাই-মুম্বই আন্ডারওয়াটার রেল প্রকল্পের মতো অনেক মিশন নিয়ে বিশ্বে কাজ চলছে। চিন সমুদ্রপথে রাশিয়া ও কানাডাকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করছে।
খরচের হিসাব
এই প্রকল্পের সঠিক খরচ অনুমান করা কঠিন। কারণ পরিকল্পনাটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে চ্যানেল টানেলের (যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স) ব্যয়ের ভিত্তিতে এটি অনুমান করা যেতে পারে। ১৯৯৪ সালে চ্যানেল টানেলের ব্যয় ছিল প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার (আজকের দামে)। মনে রাখবেন যে এই ব্যয় ছিল মাত্র ৫০ কিলোমিটারের জন্য। সেই হিসেবে মুম্বই ও দুবাইয়ের মধ্যে ২,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব বিবেচনা করলে, এই প্রকল্পে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে। যদিও সমুদ্রের মধ্যে থাকার কারণে, জমি অধিগ্রহণের মতো কোনও সমস্যা হবে না, তবে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের অবনতির আশঙ্কা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এটি বাস্তবে পরিণত হলে, এটি পরিবহন এবং বাণিজ্যের জগতে বিপ্লব আনবে।