জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মোট ২৬ জন সাধারণ মানুষ। সেই হামলার পর থেকেই সারা দেশে পাকিস্তান স্পনসর্ড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ তুঙ্গে ছিল। প্রত্যেক ভারতীয়েরই একটাই কথা ছিল—এই হামলার উপযুক্ত জবাব চাই। অবশেষে হামলার ১৫ দিন পর ভারত সেই বদলা নিল। মঙ্গলবার (৬ মে) গভীর রাতে ভারতীয় সেনা পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের (POK) ৯টিরও বেশি জঙ্গি ঘাঁটিতে আঘাত হানল। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে 'অপারেশন সিঁদুর'।
অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আজ অর্থাত্ বুধবার যে সরকারি প্রেস কনফারেন্স হয়, সেখানে তিনজন মুখ্য ব্যক্তিত্ব সাংবাদিকদের সামনে আসেন। বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রি ছাড়াও হাজির ছিলেন দুই মহিলা সেনা অফিসার—কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার বিয়োমিকা সিং। এই দুই মহিলা অফিসার সাংবাদিক বৈঠকে ভারতের সেনার বীরত্বের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, কীভাবে ভারতীয় সেনা একের পর এক পাকিস্তান পোষিত জঙ্গি শিবির ধ্বংস করছে এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছে।
এই দুই সাহসিনী অফিসারের কথা এবং উপস্থিতি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। দেশের প্রতিটি মানুষ তাঁদের কুর্নিশ জানাচ্ছেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে—এই দুই মহিলা অফিসার আসলে কে? কীভাবে তাঁরা এই ঐতিহাসিক মঞ্চে উঠে এলেন? চলুন এবার তাঁদের গল্পটা জেনে নিই।
উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং কে?
উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং ২০০৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভারতীয় বায়ুসেনায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে এই সময়ের অন্যতম সেরা উইং কমান্ডার বলা হয়। বিশেষ করে যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় এমন হেলিকপ্টার ওড়ানোর অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে তাঁর। চিতা, চেতক ইত্যাদি হেলিকপ্টার চালনায় তাঁর দখল অপ্রতিরোধ্য। বায়ুসেনায় যোগ দেওয়ার ১৩ বছর পর, ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি উইং কমান্ডারের পদে উন্নীত হন। বর্তমানে ব্যোমিকার ঝুলিতে রয়েছে হাজার হাজার ঘণ্টার উড়ানের অভিজ্ঞতা, যা তাঁকে একেবারে বিশেষ করে তুলেছে।
ব্যোমিকা সিং জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল বায়ুসেনায় যোগ দেওয়ার। ক্লাস ৬-এ পড়ার সময়ই তিনি ঠিক করেছিলেন আকাশই হবে তাঁর ঠিকানা। এক মজার গল্প শেয়ার করে তিনি বলেছেন, একদিন স্কুলে নাম নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখন তিনি জানান, 'ব্যোমিকা' শব্দের অর্থ—যিনি আকাশকে মুঠোয় ধরেন। সেই দিনই নাকি তিনি ঠিক করে নেন, একদিন আকাশ জয় করবেন। বিয়োমিকা জানান, যখন তিনি পড়াশোনা শেষ করেন, তখনও বায়ুসেনায় মহিলাদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তবে সেসব বাধা পেরিয়ে UPSC-এর মাধ্যমে তিনি ভারতীয় বায়ুসেনায় প্রবেশ করেন এবং হেলিকপ্টার পাইলট হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা তাঁকে আরও শক্তপোক্ত করে তুলেছে। ২০২১ সালে ভারতীয় বায়ুসেনার মহিলা দলের নেতৃত্বে বিয়োমিকা সিং মাউন্ট মণিরাং অভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন, যা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেছে।
কে এই কর্নেল সোফিয়া কুরেশি?
সোফিয়া কুরেশির নাম এখন গোটা দেশের মুখে মুখে ঘুরছে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়েও চলছে তাঁর সাহসের প্রশংসা। কিন্তু এই সাহসিনী অফিসারের জীবনকথা জানলে আপনারও গর্ব হবে। সোফিয়ার জন্ম গুজরাটে। পড়াশোনা করেছেন বায়োকেমিস্ট্রিতে এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ভারতীয় সেনায় যোগ দেন তিনি। ১৯৯৯ সালে সোফিয়া শোর্ট সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোর-এ অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বলা ভালো, সেনাবাহিনীই তাঁর রক্তে মিশে আছে। কারণ তাঁর দাদুও ছিলেন ভারতীয় সেনায়। এখানেই শেষ নয়, সোফিয়ার স্বামীও সেনাবাহিনীর মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রিতে অফিসার হিসেবে কর্মরত।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে একা মহিলা কমান্ডার
সোফিয়ার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ২০১৬ সালে। তখন তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন। সেই বছর মার্চ মাসে পুনেতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি বিশাল আন্তর্জাতিক সেনা মহড়া। এই মহড়ায় অংশ নিয়েছিল ১৮টি শক্তিশালী দেশ—যেমন চীন, জাপান, রাশিয়া, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি। সেই বহুজাতিক মহড়ায় ভারতীয় সেনার টিমের নেতৃত্ব দেন সোফিয়া কুরেশি। তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা অফিসার, যিনি ওই মহড়ায় কোনো সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
শুধু তাই নয়, শান্তি স্থাপনা মিশনেও সোফিয়ার অবদান অসাধারণ। ২০০৬ সালে তিনি কঙ্গোতে রাষ্ট্রসংঘের শান্তি মিশনে মিলিটারি অবজারভার হিসেবে কাজ করেছিলেন। এরপর ২০১০ সাল থেকে একের পর এক শান্তি স্থাপনা প্রকল্পে যুক্ত থেকেছেন তিনি।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর নায়িকা
সোফিয়া কুরেশি আবার প্রমাণ করলেন, তিনি শুধুই অফিসার নন, দেশের প্রকৃত সাহসী সৈনিক। অপারেশন সিঁদুরের পর তিনি যে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে গোটা দেশ তাঁর জন্য গর্বিত। তিনি পাকিস্তানের সব মিথ্যা কথা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ভেঙে দিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন, ভারত আজ আর চুপচাপ সহ্য করবে না।