কলকাতায় দুর্গাপুজো আর পুজোআচ্চায় থেমে নেই। বরং তা হয়ে উঠেছে বাঙালির সৃজনশীলতার প্রকাশের মাধ্যমে। পুজোর কটা দিন শহর যেন হয়ে ওঠে শিল্পের প্রদর্শনী! উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে পরিযায়ী শ্রমিক, অথবা দক্ষিণ ভারতের কোনও মন্দিরের অবিকল প্রতিকৃতি মাথা তুলে দাঁড়ায় শহরের বুকে। লাইন দিয়ে দর্শক দেখেন থিমের পুজো। কিন্তু, পুজোর হাজার ওয়াটের আলোর নীচেই অন্ধকারে যেন চাপা পড়ে যান থিমের কারিগররা। যাঁরা দিনরাত মেহনত করে কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দেন।
সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারের এবারের থিম রাম মন্দির। দিনরাত এক করে কাজ করছেন কারিগররা। বাঁশের কাঠামো তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন চলছে প্লাউড লাগানোর কাজ। ঠক ঠক ঠকা ঠক করে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক মারছেন কারিগরা। তাঁর ফাঁকেই চলল কথা। কোত্থেকে আসছেন? জবাব এল, 'কাঁথি'। কাঁথির স্বপন মহাপাত্র বলে চললেন,'প্যান্ডেল বাঁধার কাজ করি। পুজোর সময় একটু বেশি আয় হয়। সেই আশাতেই চলে এসেছি কলকাতায়।'
কাঁথি থেকে এসেছেন রবীন্দ্র সিংহ। গতবার লেবুতলা পার্কের পুজোর থিম লালকেল্লা তৈরি করেছিলেন। এবার তাঁর হাতে তৈরি হচ্ছে রাম মন্দির। রবীন্দ্র বলেন,'পুজোর সময় এখানে রোজগার করতে আসি। প্যান্ডেল তৈরির কাজ করি।' পুজো দেখে যান? রবীন্দ্র জানালেন,'না, প্যান্ডেল নির্মাণ শেষ হলেই বাড়ি চলে যাব।' আর এক কারিগর জানালেন, দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। দুর্গাপুজোর পর কালীপুজোর বায়না। বছরের বাকি সময়টা সামান্য জমিতে চাষাবাস করেন।
বাঁশের কাঠামোর উপরে উঠে প্লাউড লাগাচ্ছিলেন নবীন। বাড়িতে কজন আছে? তিনি বললেন, 'ভরা সংসার, মা-বাবার সঙ্গে স্ত্রী ও এক মেয়ে। মেয়ে স্কুলে পড়ে।' যৎসামান্য রোজগারের আশাতেই মেদিনীপুর থেকে চলে এসেছেন কলকাতায়। থাকবেন মহালয়া পর্যন্ত। ততদিনে শেষ হয়ে যাবে মণ্ডপ তৈরির কাজ। কলকাতার পুজো দেখবেন না? উত্তর এল,'বাড়ি স্ত্রী-মেয়ের সঙ্গেই পুজো কাটাব।'
পুজোয় রাম মন্দির দেখে যখন দর্শক বলবেন,'আহা! কী দেখলাম।' নবীন, রবীন্দ্র ও স্বপনরা আড়ালেই থাকবেন। কবি সেই কবে বলে গিয়েছেন, 'দুঃখ সুখ দিবসরজনী, মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-'পরে ওরা কাজ করে।'