কালীপুজোয় সুরা (কারণবারি) কেন লাগে? প্রতি বছর এই প্রশ্ন ঘিরে জাগে বিস্ময়, বিতর্ক ও কৌতূহল। অনেকেই মনে করেন, কালীপুজোয় সুরা রাখা আবশ্যিক, আবার কেউ বলেন, এ শুধুই লোকাচার। কিন্তু শাস্ত্র, ইতিহাস ও তন্ত্রসাধনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে উঠে আসে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক চিত্র।
সর্বভারতীয় প্রাচ্য বিদ্যা অ্যাকাডেমির প্রিন্সিপাল ডঃ জয়ন্ত কুশারীর কথায়, 'তন্ত্রের দুটি আচার। একটি দক্ষিণাচার, অন্যটি বামাচার। বামাচারের পুজো যারা করেন, তাঁরা মদ্য বা সুরা দেন। আর দক্ষিণাচারীরা সিদ্ধি দিয়ে পুজো করেন। বাংলায় দুটো ধারাতেই পুজো হয়। কালীঘাট ও দক্ষিণেশ্বরে যেমন দক্ষিণাচারে পুজো হয়। তবে দোকান থেকে কেনা মদ্য বা সুরা দেওয়া যায় না। ওটা শোধন করে দেওয়া হয়। আমি দক্ষিণাচারী, আমি মাকে কখনও সুরাপান করাতে পারব না। তবে আমি কাউকে দোষারোপ করব না। সবার বিশ্বাস এক নয়।'
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে, শুধু শ্মশানকালী রূপে দেখা যায় সুরার পাত্র হাতে দেবীকে, যেখানে তিনি উন্মত্ত ও বিভোর। তবে এটি গৃহস্থালী কালীপুজোর নিয়ম নয়। অনেকে মনে করেন, এখানে সুরার অর্থ অ্যালকোহল নয়। তন্ত্রসাধনায় 'সুরা' অর্থ হতে পারে অন্তর্লীন আনন্দধারা। অর্থাৎ, কুণ্ডলিনী জাগরণের পর মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে নেমে আসা অমৃতস্রোত। এটি ভোগের নয়, ভক্তির রূপ।
অন্যদিকে, ইতিহাস বলে, তন্ত্রসাধক ঋষি বশিষ্ঠ তিব্বতে দেবী তারা সাধনার সময় সুরার ব্যবহার দেখে অভিভূত হয়ে তা বাংলায় নিয়ে আসেন। এখান থেকেই বাংলায় কালীপুজোয় সুরার যোগ। এ প্রথার উৎস উপজাতীয় সমাজে, যেখানে চামুণ্ডা বা কালীর উদ্দেশ্যে পশুবলি ও সুরার উৎসর্গ প্রচলিত ছিল।
পাশাপাশি অনেকের অভিযোগ, আজকের দিনে কালীপুজোয় যেভাবে মদ্য উৎসর্গ হয়, তা অনেকসময় শাস্ত্রবিরুদ্ধ লোকাচার হয়ে দাঁড়ায়। যার সঙ্গে তন্ত্রসিদ্ধি বা আধ্যাত্মিকতা কম, আর লোকসংস্কৃতি ও সামাজিক রূপ অনেক বেশি। তাই প্রশ্ন ওঠে, মা কি সুরা পান করেন? হয়তো উত্তরটা একেবারে সরল নয়। কিন্তু এই জটিলতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির কালীপুজোর বহুবর্ণ আবেগ ও ঐতিহ্য।