পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডার খোলা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ছিল টানটান উত্তেজনা। জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহের ঠিক বাঁদিকে এক অন্ধকার কুঠুরিতে নাকি আছে বিষধর সাপের আড়ত। এটি দীর্ঘদিনের অন্ধবিশ্বাস। তারাই নাকি জগন্নাথদেবের সমস্ত ঐশ্বর্য হিরে-জহরত-মণি-মানিক্য পাহারা দিচ্ছে। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল অর্থাৎ ছয় বছর আগে এই কুঠুরি পরিদর্শন করতে গেছিল হাইকোর্ট নিযুক্ত একটি কমিটি। শোনা যায় এই কমিটি সঙ্গে করে সাপের ওঝাদের নিয়ে গেছিল। আর স্নান করে শুদ্ধ হয়ে কোমরে একটি মাত্র গামছাকে সম্বল করে যেতে হয় রত্নভাণ্ডার খুলতে। এবং রত্নভাণ্ডারের মধ্যে আছে ‘বাহির ভাণ্ডার’, আবার আছে ‘ভিতর ভাণ্ডার’। দুয়ারের পর দুয়ার। সেখানে এএসআই স্থাপত্য বিধি হোক আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসারই হোক, সরকারি কর্তা বা সেবায়েতই হোক সকলকে একই পোশাক যেতে হবে।
কেউ একদৃষ্টে রত্নের দিকে তাকায় না
এই রত্নভাণ্ডার এতদিন কেন খোলা যায়নি? তার কারণ রত্নভাণ্ডারের চাবি নাকি হারিয়ে গেছিল। জগন্নাথদেবের মণি মুক্তার দিকে স্থির চোখে যে তাকায় তার চোখ নাকি অন্ধ হয়ে যায়। এটাও একটা অন্ধবিশ্বাস। ভিতরে এত অন্ধকার যে সার্চ লাইট জ্বালাতে হয়। কিন্তু কেউ একদৃষ্টে রত্নের দিকে তাকায় না। জাফরি কাটা দরজায় জোরালো আলো ফেলে ভয়ে ভয়ে সেখানে সব পরিদর্শনকারীরা গিয়েছিলেন। এত বছর পর এবারেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের রহস্য এখন আরও গাঢ় হয়ে গেছে। এখন তদন্ত করে দেখা হবে কি আছে কী নেই? সময় লাগবে। ওড়িশার এই বিধানসভার ভোটেও কিন্তু বিজেপির প্রচারের মস্তবড় হাতিয়ার ছিল রত্নভাণ্ডারের চাবি হারিয়ে যাওয়া। বিজেপির দাবি ছিল ক্ষমতায় এলে এই রত্নভাণ্ডারের চাবি খোলা হবে এবং রহস্য উদঘাটন হবে।
ভিতর ভান্ডারের অষ্টধাতুর চাবিটি থাকার কথা শুধুমাত্র পুরীর প্রশাসকের কাছে
‘বাহির ভাণ্ডার’-এ জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের বেশভূষা গয়নাগাটি এই সব থাকে। সেখানে তিন গোছা চাবির ব্যবস্থা ছিল। শ্রীমন্দিরের প্রধান সেবায়েত গজপতি রাজা। দেশের আইন বলে, ১৯৬০ থেকে মন্দিরের সত্বাধিকারী এখন ওড়িশার প্রশাসন। অর্থাৎ জেলার কালেক্টর। যাকে আমরা বলি জেলাশাসক। আর ঠাকুরের সাজগোজের সেবায়েত ভাণ্ডার আছে। ঈশ্বরকে সাজগোজ করানোর যে ঘর তারও একটা আলাদা চাবি আছে। ভিতর ভান্ডারের অষ্টধাতুর চাবিটি থাকার কথা শুধুমাত্র পুরীর প্রশাসকের কাছে। অর্থাৎ জেলাশাসকের কাছে। ভক্ত পরিমণ্ডল। পুরা সামগ্রী সেই চাবিটুকুই অমূল্য সম্পদ। চাবি হারানোর শোক জগন্নাথ পরম্পরায় বিশ্বাসীদের বুকে ভীষণ বিঁধে ছিল তিরের মতো। নবীন পট্টনায়েকের ঘনিষ্ঠ দক্ষিণী আমলা পান্ডিয়ানকে ঠুকে বিজেপি দারুণ প্রচার চালিয়ে ছিল যে, কী হল? সেই ভাণ্ডারের চাবি কি তাহলে তামিলনাডুতে চলে গেছে?
অবস্থা সঙ্গীন পুরাতাত্ত্বিকরাই বলছেন
যাই হোক রাজনীতির কথা থাক। বিজেপি এখন ক্ষমতায় এসেছে। চাবি হারানোর পর রত্নভাণ্ডার আর খোলা হয়নি। ১৯৭৮ সালের ১৩ মে থেকে ২৩ জুলাই শেষবার রত্নভাণ্ডারের সম্পদের খতিয়ান নেওয়া হয়েছিল। প্রভু জগন্নাথদেবের সম্পত্তি হাত পরার শঙ্কা চাউর করে এবছরে বিজেপি ভোটে তো দারুণ ফল করল। কিন্তু জরিপের আশ্বাস দিল বিজেপি। কিন্তু এই জরিপের কাজটা কিন্তু এত সোজা কাজ নয়। যাই হোক, ওড়িশার সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজেপি সরকার নিযুক্ত কমিটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ১৪ জুলাই এই ভাণ্ডার খুলে দেখার কথা বলেছিল। সুতরাং তাই নিয়ে উৎকল ভূমিতে যথেষ্ট তোলপাড় হয়েছে। ১৫ জুলাই তো উল্টোরথ বা বাহুরা যাত্রা। এরপর নানা আচার আচরণ অনুষ্ঠান শেষে ১৯ জুলাই নিলাদ্রী বিজে। সেদিনই বিগ্রহ ত্রয়ীর মন্দিরে ফেরা। এত কিছু ঝক্কির মধ্যে রত্নভাণ্ডার খুলে সম্পত্তির খতিয়ান নেওয়া এটা খুব একটা বাস্তব সম্মত নয় এটা সবাই জানে। কিন্তু অনন্ত দরজাটুকু খোলার পর না হয় খতিয়ানের সময় লাগবে। দরজা তো খোলা হল। ভিতর ভাণ্ডারের দেওয়ালে নাকি ফাটল ধরেছে। দ্বাদশ শতকের মন্দির। অবস্থা সঙ্গীন পুরাতাত্ত্বিকরাই বলছেন। রুড়কির সেন্ট্রাল বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট আর আইআইটি চেন্নাইয়ের স্থাপত্যবিদরা এসে শ্রীমন্দিরে সরেজমিনে দেখে গিয়েছিলেন। ওড়িশার ইনট্যাকের সভাপতি তথা ঐতিহ্য রক্ষাকর্মী অনিল ধির যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। তাঁর বক্তব্য, ১৯৭৮-র নথির সঙ্গে মিলিয়ে রত্নভাণ্ডারের সম্পদের খতিয়ে দেখার থেকেও সমস্যা আরও গভীরে। কোন কোন বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা দেওয়ালে ফাটলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে রত্নভাণ্ডারের খুপরি না সরালে গর্ভগৃহটাই তো ধসে পড়বে। যাইহোক শ্রী মন্দিরের সেবায়েতরা প্রশাসকের ওয়াকিবহাল রত্নভাণ্ডার সরাতে সম্পদের খতিয়ান নিতে বিরাট ভাবে ব্যস্ত। প্রশ্ন উঠছে মণি মুক্তা অন্য কোনও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? তাহলেও সেটা কোথায়? কিভাবে, কতদিনের জন্য? এইসব প্রশ্ন আজ জগন্নাথদেবের ভক্তদেরকেও তাড়া করে ফিরছে।
কিন্তু কী আছে এই রত্নভাণ্ডারের মধ্যে? তারও একটা খতিয়ান আপনাদের দিই:-
মোট সম্পদের খতিয়ান।
—-----------------------
৪৫৪টি সোনার গয়না।
১২৮৩৮ ভরি।
২৯৩ টি রুপোর গয়না।
২২১৫৩ ভরি।
ভিতর ভান্ডার।
………………..
৩৬৭ টি সোনার গয়না।
৪৩৬৪ ভরি।
২৩১ টি রুপোর গয়না।
১৪৮৭৮ ভরি।
বাহির ভান্ডার।
—--------------
জগন্নাথ দেবের বিভিন্ন বেশের সাজসজ্জা।
৭৯ টি সোনার গয়না।
৮১৭৫ ভরি।
৩৯ টি রুপোর গয়না।
৪৬৭১ ভরি।
নিত্য ব্যবহার্য সোনাদানা।
৮ টি সোনার উপকরণ।
২৯৮ ভরি।
২৩ টি রুপোর উপকরণ।
১৮১৩ ভরি।
তবে খোলার সময়ও পাঁজি দেখে,সময় দেখে করা হয়েছে। মধ্যাহ্নে ঘটনাটি হয়েছে। আর রত্নভাণ্ডার খোলার পর মন্দির চত্বরে জয় জগন্নাথ,জয় জগন্নাথ ধ্বনি শোনা গেছে। আনন্দ মুখরিত পুরী। এবং এই খবর পুরী থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে দেশে এবং দেশের বাইরে।
জগন্নাথ কেন মা সিমলার ভৈরব?
জগন্নাথদেব আসলে ভারতীয় সমাজের একটা বহুমুখী সংস্কৃতি। জগন্নাথদেবের মধ্যে আধ্যাত্মিক, জাগতিক বিষয় থেকে বিভিন্ন যুগের রাজনীতি লোকাচার সবকিছু জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘উড়িষ্যার দেবক্ষেত্র’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, 'জগন্নাথের মাহাত্ম্য বৃহৎ ভারতভূমিতে অদ্বিতীয়। তিনি শুধু ব্রাহ্মণদের দেবতা নহেন,আচন্ডাল সকলেরই তাহাতে সমান অধিকার। তিনি বিষ্ণুর অবতার। পতিতের পাবনা। পরম অহিংসক। তাহার দুয়ারে দাঁড়াইয়া সর্বদেশ,সর্বলোক একাকার। জাতিভেদময় ভারতে জাতিভেদের এমন গুরুতর প্রতিবাদ আর কোথাও দেখা যায় না। এই জাতি বিহীন মহাতীর্থে আসিয়া নানকী,কবীরী প্রচানপন্হী,নব্যপন্হী নানা মতের নানা মুনি একই জগন্নাথের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ধন্য হয়েন। আশ্চর্য এই যে ভিন্ন মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের দেবতা অবধি জগন্নাথের মন্দির প্রাঙ্গণে স্থান লাভ করিয়াছেন। আর সেই বিমলাদেবীর দেবভোগ সম্বন্ধেও ব্যবস্থার ত্রুটি হয় নাই। জগন্নাথ বৈষ্ণব বলিয়া সর্বজনবিদিত।' কিন্তু তাঁর মন্দিরে অনেক তন্ত্রাচার্যের বৈষ্ণবীকরণ হয়েছে শোনা যায়। ঘষা জল ও মাসকলাই ভোগের ব্যবস্থা নাকি তান্ত্রিক কারণসলিল এবং আমিষাশীরই বৈষ্ণব বিধান। সেই সূত্রেই এই প্রশ্ন বৈষ্ণব ক্ষেত্রে বিমলা কেন স্থান পেলেন। জগন্নাথ কেন মা সিমলার ভৈরব? এর উত্তর পাওয়া যায় পুরাণের নানা ঘটনাবলীতে।