রথযাত্রার আজ ষষ্ঠ দিন। পুরী এখনও রথযাত্রার ভাবে বিভোর। জগন্নাথ দেব গুন্ডিচার মন্দিরে এখনও অবস্থিত। উল্টোরথের দিন তিনি আবার ফিরে আসবেন মন্দিরে। মূল জগন্নাথের মন্দিরে এখন প্রধান কর্তাই অনুপস্থিত। ভক্তেরা তবু গুন্ডিচায় যেমন যাচ্ছেন, তেমন মূল মন্দিরেও যাচ্ছেন। আর এসবের মধ্যেও বলরামের মূর্তির পতন কাহিনি নিয়ে রাজনীতির একটা নতুন মোড় দেখা গেল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক, নতুন মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝিকে একটি চিঠি দিয়ে বলেছেন, বলভদ্রের মূর্তির পতন, একে কেন আপনারা ছোট ঘটনা বলে বর্ণনা করছেন? দুই উপমুখ্যমন্ত্রী তো এ কথাই বলেছিলেন। তার নিন্দা করেছেন নবীন পট্টনায়ক। তিনি বলেছেন, কখনও তো এমন হয়নি। কাজেই এই ঘটনা কেন হল, তার প্রশাসনিক দায় কার— এ সব নিয়েও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর কখনও না হয়।
তবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, তিনিও কিন্তু খুব ভাল শিষ্টাচারের নজির রেখেছেন। তিনি নবীন পট্টনায়ককে একটি চিঠি দিয়ে বলেছেন, আপনি ঠিক বলেছেন। আপনার পরামর্শ শিরোধার্য করলাম। এ ঘটনাকে ছোট ঘটনা বলা ঠিক হয়নি। আর সুষ্ঠুভাবে অনুসন্ধান করে নিশ্চয়ই দেখব, কেন এমন হল। আর ভবিষ্যতে কখনও এমন ঘটনা যাতে না হয়, তার দায়িত্বও আমি নিচ্ছি। এমনটাই কথা দিয়েছেন ওড়িশার নতুন মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝি। কোনও সন্দেহ নেই, মুখ্যমন্ত্রীর এই চিঠি সাম্প্রতিক বিতর্কের অবসান ঘটাবে। দলমত নির্বিশেষে সকলে জানতে চাইবে, কেন এমন হল?
জগন্নাথ মন্দিরের আর একটি সুখবর, মন্দিরের রত্নভাণ্ডারটি খোলা হবে। ১৪ জুলাই সেটি খোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে। এই রত্নভাণ্ডারটি যে কত যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! এমন কথাও শোনা যায় যে, রত্নভাণ্ডার থেকে অনেক রত্ন চুরিও গেছে অতীতে। মন্দিরের রত্নও থাকে, চুরিও হয়। এ কোনও নতুন বিষয় নয়। তবে রত্নভাণ্ডার খোলার সিদ্ধান্তকে সাধারণ মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। এই রথযাত্রায় এটিও একটি ভক্তদের বড় পাওনা। জগন্নাথের রত্নভাণ্ডারে কী আছে, কী নেই, তার একটা প্রাচীন তালিকা ছিল। এখন সব হিসেব-নিকেষ করে দেখা হবে। রাজার নেতৃত্বে কমিটি যেমন আছে, এখন তো নতুন বিজেপি সরকারও এই ব্যাপারে উদ্যোগী, যাতে এই রত্নভাণ্ডার নিয়ে সব বিতর্কের অবসান হয়।
আজ গেলাম গম্ভীরায়। গম্ভীরার মঠ রথযাত্রার সময় দর্শনের বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা আছে। কারণ, এখানেই তো শ্রীচৈতন্য প্রায় দু’দশক কাটিয়েছেন। আগেই বলেছিলাম, গম্ভীরা শব্দটি এসেছে স্থানীয় উৎকল ভাষা থেকে। যেখানে গম্ভীরি শব্দটির মানে হচ্ছে, একটা গোপন ছোট অন্ধকারময় ঘর। এইরকম একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে থাকতেন শ্রীচৈতন্যদেব। সেখানে তিনি সাধনা করতেন। এই কক্ষটির বাইরে রডের গরাদ দেওয়া। দেখে মনে হচ্ছে যেন জেলের কুঠুরি। ভিতরে শ্রীচৈতন্যদেবেই মূর্তি। আর এই আশ্রমের কাছেই রয়েছে সেই বিখ্যাত বকুল গাছ। যেখানে শ্রীচৈতন্যদেব সাধনা করেছেন। বকুল গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি মঠ। বকুল গাছটি সিদ্ধ-বকুল বলেই পরিচিত। এই সিদ্ধ-বকুলকে কেন্দ্র করে সিদ্ধ-বকুলমঠ গড়ে উঠেছে। এই বকুল গাছের তলায় শ্রীচৈতন্যদেব সিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই কারণেই এর নাম সিদ্ধ-বকুল।
বকুল গাছটির প্রাচীন যে মূল, সেটা অনেকটা ভেঙে গেছে। খুব চওড়া শিকড়। তারপর আবার কোনও একটা অংশ থেকে নুতন করে বকুল গাছের জন্ম হয়েছে। এখন যত্ন করে রাখা হয়েছে। বটগাছ যেরকম শক্তিশালী হয়, বকুলগাছও কিন্তু সেইরকমই শক্তপোক্ত একটা বৃক্ষ। সেটাকে দর্শন করলাম সেই বকুল বৃক্ষটিকে। এখানে যারা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত, তারাই মূলত এখানে সবথেকে বড় দর্শনার্থী। সাধারণ মানুষের ভিড় কম। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। সেটা হচ্ছে, জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাকে ঘিরে যে উন্মাদনা, চৈতন্যদেবের স্মৃতি বিজড়িত গম্ভীরা এবং এই সিদ্ধ বকুলমঠ, সেখানে কিন্তু সেই ভিড়, সেই উত্তেজনা নেই।