অম্বুবাচীর সময়ে দেবীমূর্তি দর্শণ নিষিদ্ধ। বন্ধ থাকে দেশের অধিকাংশ সতীপীঠ মন্দিরগুলি। এইসময় অম্বুবাচী ব্রত পালন করেন বাড়ির মহিলারা। বছরের এই বিশেষ সময় এমনকিছু রহস্যময় ঘটনা ঘটে, যার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেন না কেউই। বছরের নির্দিষ্ট তিনদিন। মূলত আষাঢ় মাসেই পালিত হয় অম্বুবাচী ব্রত। শাস্ত্রমতে দেবীর ঋতুকালিন অবস্থা।
কামাখ্যা দেবীর অন্যতম সতীপীঠ। এখানেই পড়েছিল দেবীর যোনি, ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এমনটাই। একাধিক রহস্যে ঘেরা পূর্বভারতের এই মন্দির। অনেকেই মনে করেন, এখানে গুপ্ত সাধনায় রত হন তান্ত্রিকরা। কথিত আছে, এই মন্দির জাদুবিদ্যা, মোহিনীবিদ্যা, ডাকিনীবিদ্যা সহ একাধিক গুপ্তসাধনার পীঠস্থান। আর সেই তন্ত্রপীঠের বার্ষিক উদযাপন হয় অম্বুবাচীর উৎসবে।
তবে অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে বিশেষ মেলা বসে আসামের কামাখ্যা মন্দিরে। মাতৃমন্দিরে সে সময়ে দর্শন হয় না যদিও। কথিত আছে, এইসময় গর্ভগৃহে লাল তরল লক্ষ্য করা যায়। ভক্তরা সাদা কাপড় দিয়ে পুজো দেন অম্বুবাচীর আগে। সেই কাপড় ৩ দিন পর সম্পূর্ণ লাল হয়ে তাঁদের কাছে ফেরত আসে। আসলে ওই কাপড় রাখা থাকে কামাখ্যা মায়ের গর্ভগৃহের বিশেষ স্থানে। সেখান থেকে আগত লাল তরলের জেরেই ওমন হয়ে যায় সাদা কাপড়।
গবেষকদের মতে, গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। যা আসলে একটি ভূগর্ভস্থ গুহা। এখানে কোনও বিশেষ মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত রয়েছে। সেখানে অম্বুবাচীর সময় প্রবেশাধিকার থাকে না। এই বিশেষ সময় লাল হয়ে যায় ব্রহ্মপুত্র নদীর জলও। আজ অবধি যার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি কেউ। মনে করা হয়, দেবী ঋতুকালের প্রভাবেই এই বিশেষ পরিবর্তন হয়। পাশাপাশি অম্বুবাচীর সময় নাকি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরের দরজা। ৩ দিন পর সেই দরজা খোলে। দরজা খুলতেই উপচে পড়ে ভক্তদের ভিড়।
অম্বুবাচীর পর কামাখ্যা মন্দির দর্শণে বিশেষ ফল মেলে। আর ওই লাল কাপড় কেউ যদি বাড়িতে রাখেন, তাহলে যাবতীয় দুর্ভোগ কেটে যায়। এই বিশ্বাসেই বছরের পর বছর ধরে অম্বুবাচী ব্রত পালন করে আসছেন ভক্তরা। বিভিন্ন প্রান্তের সাধু সন্ন্যাসীরা এই সময় কামাখ্যা মন্দিরে ভিড় জমান।
গর্ভগৃহে আয়োজন করা হয় বিশেষ পুজো। এর সেই পুজো ঘিরেই লুকিয়ে আছে রহস্য। এই গুপ্তপুজোয় অংশ নেওয়ার অধিকার থাকে না সাধারণ মানুষের। অনেকেই মন্দির সংলগ্ন পাহাড়ে বসে জপ-তপ করেন। যে নির্দিষ্ট স্থানে দেবীর যোনি স্বরূপ শিলাখণ্ডটি পড়েছিল সেই স্থান অম্বুবাচীর সময় লাল হয়ে যায়। ভক্তরা পুজোর জন্য সাদা কাপড়ের খন্ড দান করেন। অম্বুবাচীর পর সেই সমস্ত সাদা কাপড় লাল হয়ে যায়। প্রতিবছর এই অদ্ভুত অবস্থা স্বচক্ষে দেখার দাবি করেন অনেক ভক্তই।
মন্দির খুললে রাজকীয় পুজোর আয়োজন করা হয়। মাতৃমূর্তি স্নান করানো হয়। হাজার হাজার ভক্ত দর্শন করতে ভিড় জমান মন্দিরে। শুধু কামাখ্যা মন্দিরই নয়, যে কোনও মাতৃমন্দিরেই অম্বুবাচীর পর বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। বিধবা, ব্রাহ্মণ এবং ব্রহ্মচারীরা অম্বুবাচীর সময়ে রান্না করা খাবার খান না। ৩ দিন পর, গৃহস্থালির জিনিসপত্র, বাসনপত্র এবং কাপড় শুদ্ধ করা হয়। এছাড়া ঘরও পবিত্র হয়। এর পরেই কামাখ্যা দেবীর পুজো শুরু হয় এবং মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
অসমের কামাখ্যা মন্দিরে ভক্তদের দুই ধরনের নৈবেদ্য দেওয়া হয়, যাকে অঙ্গোদক এবং অঙ্গবস্ত্র বা অম্বুবাচী বলা হয়। অঙ্গোদক মানে ঝরনার জল আর অম্বুবাচী মানে দেবীর কাছে রাখা কাপড়। অম্বুবাচীর ৩দিন কোনও শুভ কাজ নিষিদ্ধ থাকে। মন্ত্র পড়ে পুজোও করা যায় না, কেবল ধূপ জ্বালিয়ে পুজো সারতে হয়। এমনকী চাষবাসও বন্ধ রাখা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ঋতুকালে মেয়েরা অশুচি থাকেন। একই ভাবে মনে করা হয়, অম্বুবাচীর সময়ে পৃথিবীও অশুচি থাকে।
বিভিন্ন পরিবারের বয়স্ক বিধবা মহিলারা তিন দিন ধরে অম্বুবাচী উপলক্ষে বিশেষ ব্রত পালন করেন৷ তিনদিন পরে জামাকাপড়, বিছানা সাবান দিয়ে ধুয়ে, নিজেরা সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করে, তবে রান্নাঘরে ঢোকেন, স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। অম্বুবাচী চলাকালীন বিভিন্ন মন্দির ও বাড়ির ঠাকুর ঘরের মাতৃ শক্তি যেমন কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, বিপত্তারিণী, শীতলা, চণ্ডীর প্রতিমা বা ছবি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অম্বুবাচী শেষে দেবীকে আম-দুধ নিবেদন করতে হয়।