করোনার প্রভাব পড়েছে দুর্গাপুজোতেও। গত বছরের পুজো তবু কিছুটা অর্থ তহবিল থেকে বের করে জমক ছিল। এবার আরও ধসে গিয়েছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। অনেক বেশি সতর্ক হয়ে, বিধিনিষেধ মেনে আয়োজন করতে হচ্ছে পুজোর। সে কারণে এ বছর চারণ কবি মুকুন্দ দাসের প্রতিষ্ঠিত আনন্দময়ী কালীবাড়ির দুর্গাপুজো থেকে বাদ যাচ্ছে জাঁকজমক। তবে যেহেতু মন্দিরের পুজো, তাই রীতিনীতি আচার মেনে বিধিমতেই পুজো সারবে কর্তৃপক্ষ। ফলে কিছুটা আক্ষেপ থাকছেই।
চারণকবির মন্দির
এই মন্দিরের পড়তে পড়তে ইতিহাস জড়িয়ে। কারণ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা চারণকবি মুকুন্দ দাস নিজে। শুরুর দিকে কিছুটা খুঁড়িয়ে চললেও, পরে যত দিন গিয়েছে প্রতি বছর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এই পুজোর কলেবর, শ্রী।
বাধ্য হয়ে আড়ম্বর বর্জন
গত বছরও সেখানে সাধারণভাবে জনতা বিবর্জিত হয়ে পুজো সারা হয়েছিল। সেখানকার এই জাঁকজমকহীনতায় মন খারাপ মন্দির কমিটি থেকে শিলিগুড়িবাসী, প্রত্যেকেরই। তবে পরিস্থিতি যা তাতে গোটা রাজ্য়েই একই অবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে পরিস্থিতি। মন্দির কমিটির তরফে জানালেন ভাস্কর বিশ্বাস।
রথের দিন থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি
তিনি বলেন, “ইতিহাস কালীবাড়ির দুর্গাপুজোয় দর্শনার্থীদের টেনে নিয়ে আসে। রথের দিন থেকেই মন্দির প্রাঙ্গণে শুরু হয় দুর্গাপ্রতিমা তৈরির প্রস্তুতি। শিলিগুড়ির সব থেকে পুরনো দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে দ্বিতীয় আনন্দময়ী কালীবাড়ির পুজো। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ওই মন্দিরের ভূমিকা ছিল। সেই ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরেই আনন্দময়ী কালীবাড়ির দুর্গাপুজো ৯০তম বছরে পদার্পণ করেছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থাকার কারণে রাজ্যের অন্যান্য ধর্মীয় স্থান নিয়ে পর্যটনদপ্তর যে ট্যুরিজম সার্কিট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে, সেই সার্কিটে যুক্ত করা হয়েছে কালীবাড়িকে।
১৯২৪ সালে শিলিগুড়িতে গা ঢাকা দিয়েছিলেন চারণকবি
মন্দির কমিটির সম্পাদক ভাস্কর বিশ্বাস জানান, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চারণকবি মুকুন্দ দাসের ভূমিকা সবাই জানেন। বিপ্লবী ও দেশবাসীদের নিজেদের গানের মাধ্যমে আন্দোলনে শামিল হওয়ার বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বদেশী গান ও নাটক রচনা করে ব্রিটিশ শাসকদের বিষ নজরে পড়েন। ১৯২৪ সালের মে মাসে বরিশাল থেকে শিলিগুড়ি এসেছিলেন চারণকবি। সে সময় ব্রিটিশদের রোষনজরে পড়েন তিনি।
মুকুন্দদাসের তহবিলেই তৈরি হয় মন্দির
ডিআই ফান্ড মার্কেটের পাশে বর্তমান শিলিগুড়ি থানার পিছনে একটি টিনের তৈরি কালীবাড়িতে আশ্রয় নেন। সে সময় মন্দিরের পরিস্থিতি দেখে গান গেয়ে মন্দির পাকা করার উদ্যোগ নেন। মাসখানেক গান গেয়ে পাঁচশো এক টাকা দক্ষিণা সংগ্রহ করে তা মন্দির গড়ার জন্য দান করেছিলেন। ১৯২৬ সালে মন্দির স্থায়ীভাবে স্থাপন হয়। কাশী থেকে আনন্দময়ী কালীমূর্তি এনে মন্দিরে স্থাপন করা হয় সেই সময়। মন্দিরের নাম আনন্দময়ী কালীবাড়ি নামকরণ করেছিলেন চারণকবি নিজেই। তিনি পরে কলকাতায় ফিরে গেলেও মন্দির থেকে যায় তাঁর স্মৃতি হিসেবে।
দেশের বিপ্লবীরা জড়ো হতেন এখানে
জানা গিয়েছে, পুজোর সময় সারা দেশ থেকে বিপ্লবীরা মন্দিরে একত্রিত হতেন। লাঠিখেলা, ব্যায়ামের মতো শারীরিক কসরত করতেন। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশদের পরাজিত করতে স্বাধীনতা সংগ্রামের একাধিক পরিকল্পনাও ওই মন্দিরে করা হত। সেসময় প্রথম শুরু হয় দুর্গাপুজো। রথের দিন থেকে প্রতিমা শিল্পী মন্দির প্রাঙ্গণেই মূর্তি গড়ার কাজ শুরু করতেন। তবে বর্তমানে রাজস্থান থেকে মার্বেলের স্থায়ী দুর্গা মূর্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে মন্দির কমিটি।