২০২৫ সালের শুরুতেই প্রয়াগে বসতে চলেছে মহাকুম্ভের আসর। ঠিক একই সময়ে গঙ্গাসাগরেও ভিড় করবেন তীর্থযাত্রীরা। বলা হয় উত্তরপ্রদেশের কুম্ভের পর বাংলার গঙ্গাসাগার মেলা দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ধর্মীয় মেলা। লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর ভিড় সামাল দিতে এখন প্রশাসনিক স্তরে চলছে জোর প্রস্তুতি। জানুয়ারির শুরুতেই ৮ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত চলবে গঙ্গাসাগর মেলা। মকর সংক্রান্তি লাগছে ১৪ জানুয়ারি দুপুর ২টো ৫৮ মিনিটে। পূণ্যস্নানের সময় লাগছে সকাল ৬টা ৫৮ মিনিট থেকে ১৫ জানুয়ারি সকাল ৬টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত।
প্রতিবারের মতো এবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক লক্ষ মানুষ পুণ্য অর্জনের আশায় ভিড় জমাবেন গঙ্গাসাগরের কপিলমুনি মন্দিরে। মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে চলবে ডুব দেওয়ার পালা। সাগরে পুণ্যাস্নানের পাশাপাশি কপিল মুনির আশ্রমে পুজো দেওয়া চলে পুণ্যার্থীদের। বিশ্বাসে ভর রেখেই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী মোক্ষের সন্ধানে মকর সংক্রান্তির সময়ে গঙ্গাসাগর মেলায় যান। তারা বিশ্বাস করেন, সাগরসঙ্গমের পবিত্র জলে ডুব দিলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়। এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ কপিল মুনির মন্দির দর্শন করেন।
ভক্তদের বিশ্বাস, একজন ভক্ত সমস্ত তীর্থে গিয়ে যে পুণ্য ফল পান, তা গঙ্গা সাগরের তীর্থে একবারই পেয়ে যান। এই কারণেই প্রচলিত রয়েছে ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।’ আর গঙ্গাসাগর মেলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু মেলা। হিন্দু ধর্মে, গঙ্গাসাগরে স্নানের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে স্নানের গুরুত্ব রয়েছে জ্যোতিষশাস্ত্রতেও। ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে সংক্রান্তিতে সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে স্থানান্তরিত হয়। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, মকর সংক্রান্তি শুরু হয় যখন সূর্য দেবতা মকর রাশিতে প্রবেশ করেন এবং সেখানে এক মাস অবস্থান করেন। সূর্যের এই পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী জ্যোতিষশাস্ত্রীয় তাৎপর্য রয়েছে কারণ মকর হল শনির ঘর, এবং শনি এবং সূর্য উভয়েরই একে অপরের প্রতি বিরোধী সম্পর্ক রয়েছে। শনি হলেন সূর্য দেবের পুত্র। কিন্তু মকর সংক্রান্তির সময়, সূর্য তার ছেলের প্রতি তার রাগ ভুলে যায় এবং একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রসারিত করে। এটিকে একটি শুভ সময় চিহ্নিত করা হয় এবং এর মধ্যে সম্পর্কের গুরুত্ব অন্তর্নিহিত রয়েছে। মকর সংক্রান্তি হল দীর্ঘ শীতের সমাপ্তি। পাশাপাশি এটা নতুন ফসল কাটার সময়। হিন্দু সংস্কৃতি অনুসারে, এটিকে উত্তরণের পবিত্র পর্যায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অশুভ সময়ের সমাপ্তি এবং ভাল সময়ের শুরু। এই সময় থেকে রাত ছোট এবং দিন বড় হতে শুরু করে। এটি জ্যোতিষ অনুশীলন এবং জ্যোতির্বিদ্যাগত আন্দোলনের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত বন্ধন প্রতিফলিত করে।
হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ এই তীর্থস্থান। গঙ্গা নদী এখানে সাগরে এসে মিশেছে। তাই এই স্থানের নাম গঙ্গাসাগর। এছাড়াও গঙ্গাসাগরে মকর সংক্রান্তির দিনে স্নানের পুণ্যের পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে, যে দিন শিবের চুল থেকে বের হয়ে পৃথিবীতে গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে ঋষি কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছেছিল, সেই দিনটি ছিল মকর সংক্রান্তির দিন। গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির মন্দির রয়েছে। কপিল মুনিকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করা হয়। কপিল মুনির সময়ে রাজা সাগর অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন এবং যজ্ঞের ঘোড়াগুলিকে মুক্ত করেন। বিশ্বাস করা হত যে, এই ঘোড়াগুলো কোন রাজ্য থেকে যাবে, সেখানকার রাজাকে সাগর রাজার পরাধীনতা মেনে নিতে হবে। শুধু তাই নয়, সেই ঘোড়াকে রক্ষা করতে রাজা সাগর তাঁর ৬০ হাজার পুত্রকেও পাঠিয়েছিলেন। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, একদিন হঠাৎ ঘোড়া নিখোঁজ হওয়ায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। যা পরে কপিল মুনির আশ্রমে পাওয়া যায়। রাজার ছেলেরা সেখানে গিয়ে কপিল মুনিকে কু-কথা বলে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কপিল মুনি তাঁর চোখের তীক্ষ্ণতায় সেই ষাট হাজার পুত্রকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন। বহু বছর ধরে রাজা সাগর কপিল মুনির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাননি। সেই সময় রাজার সূর্য বংশের পরবর্তী বংশধর ভগীরথ কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছেন এবং সেখানে গিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চান। তিনি পিতৃপুরুষদের মুক্তির জন্য সমাধান চেয়েছিলেন। সেই সময় কপিল মুনি তাঁকে গঙ্গার জল থেকে মুক্তির উপায় বলেন। কপিল মুনির মতে, রাজা ভগীরথ কঠিন তপস্যা করে গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। এরপরই গঙ্গার পবিত্র জলে সাগর রাজার ষাট হাজার পুত্রের আত্মা মুক্তি লাভ করে। রাজা ভগীরথের নাম অনুসারে গঙ্গার নাম হয় ভাগীরথী। রাজা সগরের নামে সমুদ্রের নাম হয় সাগর। সমুদ্র ও নদীর মধ্যবর্তী দ্বীপের নাম হয় সাগরদ্বীপ।