Advertisement

মানুষের রক্ত ছাড়া পুজো হয় না, রহস্যে মোড়া গুপ্তপুজো কোচবিহারের বড়দেবীর

গুপ্তপুজোয় রক্ত ঝড়ে এখনও। মানুষের রক্ত ছাড়া পুজো হয় না কোচবিহারের বড়দেবীর। ছমছমে ইতিহাস ও মিথ মিলে মিশে আজও রহস্যময় এই পুজো।

রহস্যে মোড়া কোচবিহারের বড়দেবী
সংগ্রাম সিংহরায়
  • কোচবিহার,
  • 20 Sep 2021,
  • अपडेटेड 12:05 PM IST
  • মানুষের রক্ত চাই বড়দেবীর
  • বড়দেবীর পুজোয় মিশে রয়েছে রহস্য ও মিথ
  • মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন নরনারায়ন

মানুষের রক্ত ছাড়া কোচবিহারের বড় দেবীর পুজো হয় না। মনুষ্য রক্তের স্বাদ পেলে তবেই পুজো সম্পন্ন হয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে এমনভাবে পুজো শুধু রোমহর্ষক তাই নয়, পুজো সম্পর্কে মানুষকে মিথ, আধিভৌতিক ফিল এনে দেয়।

আর পাঁচটা পুজো থেকে আলাদা

আর পাঁচটা দুর্গা পুজোর থেকে ভিন্ন নিয়মে পিুজো হয় কোচবিহারের বড়দেবীর। শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী থেকে পুজোর সূচনা। কোচবিহারের ভাঙ্গরাই মন্দিরে যূগছেদনের মধ্য দিয়ে এই পুজোর সূচনা হয়। একটি ময়না গাছ কেটে সেটিকে মন্দিরে নিয়ে এসে মহাস্নান করানো হয়। সঙ্গে চলে বিশেষ পুজো। এই ময়না কাঠ দিয়েই তৈরি হয় বড়দেবীর প্রতিমার মেরুদণ্ড। ভাঙ্গরাই মন্দিরে বিশেষ পুজোর পর সন্ধ্যায় সেই ময়না কাঠ নিয়ে যাওয়া হয় কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরে। সেখানে এক মাস ধরে চলে বিশেষ পুজো। এই পুজোতে পায়রা বলির প্রচলন রয়েছে।

মহারাজা বিশ্বসিংহ ও মিথ

কোচবিহারের লোকগাথা অনুসারে কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসিংহ শৈশবকালে তাঁর তিন ভাই শিষ্যসিংহ, কুমার চন্দন ও কুমার মদন এবং শৈশবের সঙ্গীদের নিয়ে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে আসামের ‘‌চিকনা’‌ নামক গভীর বনে ময়না কাঠের ডালকে দেবী দুর্গা কল্পনা করে বনফুল, ফল দিয়ে পুজো করেছিলেন।

কিংবদন্তী কাহিনী

প্রচলিত আছে, খেলাচ্ছলে এক সাথীকে রাজকুমার বিশ্বসিংহ পাঁঠার মতো আটকে রাখেন এবং মহারাজা বিশ্বসিংহ কুশ দিয়ে আঘাত করা মাত্রই দেবীর অলৌকিক ক্ষমতায় সেই বন্ধুর মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে যায়।মহারাজা বিশ্বসিংহ সেই বন্ধুর ধরহীন মাথা দেবীর নামে নিবেদন করেন। কথিত আছে যে, সেই সময় দেবী দুর্গার আশীর্বাদেই নাকি মহারাজা বিশ্বসিংহ ‘‌চিকনা’‌-‌র অধিপতি তুরকা কোতোয়ালকে পরাজিত ও নিহত করে কোচবিহারের সিংহাসনে আসীন হন। দেবী দুর্গা সেই সময় নিজের হাতের কঙ্কন ও তীক্ষ্ণ খড়গ উপহার দেন তাকে।

Advertisement

বর্তমান মূর্তি প্রতিষ্ঠা পুজোর প্রচল করেন বিশ্বসিংহের পুত্র নরনারায়ন

এখানে ময়না গাছের ডালকে দেবী দুর্গা কল্পনা করে পুজো হয়েছিল বলে আজও ময়না গাছের ডাল রাধা অষ্টমীর পুন্যতিথিতে পুজো করে দেবীপ্রতিমার শক্তিগোজ করা হয়। মহারাজা বিশ্বসিংহের পুত্র কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নরনারায়ণ স্বপ্নাদেশে স্ববংশে দশভুজা দূর্গা মূর্তির পূজার প্রচলন করেন।

চিলা রায় ও নরনারায়ন

কোচবিহারের ইতিহাস মতে, মহারাজা নরনারায়ণের ভাই সেনাপতি চিলা রায় কোচবিহারের সিংহাসনে বসবার লোভে দাদা নরনারায়ণকে হত্যা করবার জন্য রাজসভায় গিয়েছিলেন। কিন্তু, সেখানে পৌঁছে তিনি দেখতে পান, স্বয়ং ভগবতী দুর্গা দশ হাত দিয়ে ঘিরে রাজা নরনারায়ণকে রক্ষা করছেন। চিলা রায় এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দাদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু, এই ঘটনায় নরনারায়ণ নিজেকে ভাগ্যহীন মনে করেন এবং চিলা রায়কে ভাগ্যবান মনে করলেন।

বড়দেবীর স্বপ্নাদেশ

নিজের ভাগ্যে দেবী দর্শন না ঘটায় মনের দুঃখে অন্ন জল ত্যাগ করে নির্জনবাস করতে আরম্ভ করেন তিনি। জনশ্রুতি আছে যে ৩ দিন পর গভীর রাতে দেবী দুর্গা তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেন, ‘‌বৎস ওঠ, জগৎ সংসার আমার যে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজা করে তা প্রত্যক্ষ কর। শরৎকালে তুমি এই মূর্তি নির্মাণ করে যথাবিধি পূজা করবে।’‌

এখনও স্বমহিমায় চলছে পুজো

মহারাজা নরনারায়ণ সেই স্বপ্নে দেখা মূর্তি স্থাপন করে শারদীয়া দুর্গাপুজোর প্রচলন করলেন। কোচবিহার রাজবাড়ির বড়দেবী দুর্গার চেহারা বেশ ভীতি উদ্রেককারী। তাঁর গায়ের রঙ লাল, তাঁর দ্বারা দলিত অসুরের গায়ের রঙ সবুজ। দেবীর বাহন সিংহ অসুরের পায়ে কামড়ে ধরে রয়েছে। আর অসুরের হাতে কামড় বসিয়েছে একটি বাঘ। দেবীর দু’পাশে অবস্থান করছেন, দেবীর দুই সখি— জয়া-বিজয়া। বলাই বাহুল্য এই মূর্তি মহারাজা নর নারায়ণের স্বপ্নে দেখা দেবী দুর্গার রক্তবর্ণ রূপের প্রকাশ। কাল প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সেদিনের রাজতন্ত্র থেকে কোচবিহার কয়েক যোজন দূরে। কিন্তু আজ ও বন্ধ হয়নি বড়দেবী দুর্গা পুজো।

আগে নরবলি হত

কথিত রয়েছে, একদা এই মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হত। মহারাজা নরনারায়ণের আমলে এই নরবলি চালু হয়। পরবর্তীকালে নর বলির বীভৎসতা দেখে কোচবিহারের ১৯ তম কোচ মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর দ্বারা পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে নরবলি বন্ধ করে দেন। কিন্তু কোচবিহার রাজবংশের বড়দেবী দুর্গা নররক্ত না পেলে কুপিত হন। তাই প্রতি বছর মহাঅষ্টমীর রাতে এখানে এক বিশেষ ধরনের বলির ব্যবস্থা করা হয়। মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিলগ্নে বড়দেবীর মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় ‘গুপ্তপূজা’। বাইরের লোকের প্রবেশ তখন নিষিদ্ধ।

এখনও রক্ত নেন বড়দেবী

পুরোহিত এবং রাজবংশের প্রতিনিধিরাই মূলত থাকেন এই উপাচারের সময়ে। এখানে কামসানাইট উপাধিধারী প্রতিনিধি তাঁর আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর পদতলে। বলি দেওয়া হয় চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরী মানুষরূপী একটি পুতুলকে। এই সময় প্রবল শব্দে  ঢাক বাজানো হয়। আজও এই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে কোচবিহার।

 

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement