রীতি মেনেই এতদিন তারাপীঠে মা তারার বিগ্রহ স্পর্শ করে ফুলের মালা পরিয়ে পুজো দিয়েছেন ভক্তরা। এবার সেই সুযোগ হারালেন ভক্তরা। ভক্তদের জন্য তারাপীঠ মন্দিরের নিয়মকানুনে বড়সড় পরিবর্তন আনা হল। এবার থেকে আর মন্দিরে ঢুকে মায়ের চরণ স্পর্শ বা মূর্তিকে জড়িয়ে ধরা যাবে না। সেইসঙ্গে গর্ভগৃহে ঢোকা যাবে না আলতা ও গোলাপজল নিয়ে। মঙ্গলবার অর্থাৎ আজ, ১৭ ডিসেম্বর থেকেই এই নিয়ম চালু হয়েছে মন্দির চত্বরে।
আর কোনও বেনিয়ম নয়। জেলাশাসকের কড়া হুঁশিয়ারির পর আজ, মঙ্গলবার থেকে ঘড়ি ধরে ভোর সাড়ে ৫টায় সকলের জন্য খুলে দেওয়া হবে তারা মায়ের গর্ভগৃহ। তেমনই ভোগের সময় দেড়ঘণ্টা বন্ধ থাকবে মন্দির। দেবী দর্শনের জন্য আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না সাধারণ পুণ্যার্থীদের। ভোরে গর্ভগৃহ খোলার পর প্রথম একঘণ্টা সাধারণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পুণ্যার্থীদের পুজো গ্রহণ করা হবে। বিশেষ লাইনে পুজো দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই মন্দির কমিটির অফিস থেকে কুপন সংগ্রহ করতে হবে।
গর্ভগৃহে মোবাইল নিষিদ্ধ হয়েছিল আগেই। এ বার মন্দিরেও মোবাইল নিয়ে ঢুকতে পারবেন না দর্শনার্থীরা। মঙ্গলবার পৌষ মাসের প্রথম দিন থেকেই এই নতুন নিয়ম কার্যকর করেছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মন্দিরে মোবাইল নিয়ে প্রবেশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মোবাইল গেটে নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে জমা রেখে ঢুকতে হবে।
সম্প্রতি তারাপীঠ মন্দির কমিটির সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সেবায়েতদের সঙ্গে বৈঠক করেন বীরভূমের জেলাশাসক। প্রশাসনিক ওই বৈঠকে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মন্দিরে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। প্রবেশপথে কর্তব্যরত নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে জমা দিয়ে ঢুকতে হবে ফোন। সেইসঙ্গে মন্দির খুলতে ও বন্ধ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ে। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে মা তারার ভোগ নিবেদন করতে হবে। পুজো দিতে আসা ভক্তদের জন্য থাকবে দুটি লাইন। একটি সাধারণ ও আরেকটি বিশেষ। সাধারণ লাইন আগে চালু হবে। তার একঘন্টা পর চালু হবে বিশেষ লাইন। নতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভক্তদের সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছুদিন ধরেই তারাপীঠ মন্দিরে চরম বিশৃঙ্খলা চলছিল। মোটা টাকার বিনিময়ে সঙ্গে সঙ্গে মিলছিল দেবীর দর্শন। সেক্ষেত্রে সাধারণ লাইনের পুণ্যার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে রাখা হচ্ছিল। তেমনই পালাদার সেবাইতদের একাংশ মন্দিরটাকে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি ভেবে নিয়েছিল। নির্দিষ্ট কোনও সময় ছিল না। তাদের ইচ্ছেতেই গর্ভগৃহ খোলা ও বন্ধ হচ্ছিল। এমনকী লক্ষ লক্ষ টাকায় পালা অন্যকে বিক্রি করে দিচ্ছিল। আর সেই ব্যক্তি টাকা তুলতে দেবী দর্শনে নিজের মতো করে ‘রেট’ করে দিচ্ছিল। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে মন্দির খোলা হচ্ছিল। টাকা উপার্জনের নেশায় ভোগ ও আরতিরও নির্দিষ্ট সময় ভুলে যাচ্ছিলেন বরাত পাওয়া লোকজনেরা। যেখানে তীর্থভূমির পর্যটন বিকাশের জন্য রাজ্য সরকার কোটি কোটি ব্যয় করে মন্দিরের নবরূপ দিয়ে চলেছেন, সেখানে এক শ্রেণির মানুষের জন্য প্রাচীন এই সাধনাক্ষেত্রের গরিমা নষ্ট হচ্ছিল। এমনই নানা অভিযোগের পাহাড় জমছিল জেলা প্রশাসনিক স্তরে। অবশেষে এই নিয়ে মন্দির কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসেন জেলাশাসক। তিনি সতর্ক করে বলেন, এমনটা চলতে থাকলে ট্রাস্টি করে দেওয়া হবে। পুণ্যার্থীদের অসুবিধে হয় এমন কোনও কাজ করা যাবে না। সেই সঙ্গে মন্দির খোলা, ভোগ ও আরতি নির্দিষ্ট সময় মেনে যাতে হয় সেব্যাপারে কড়া নির্দেশ দেন তিনি। গর্ভগৃহের ভিতরে মোবাইল, নারকেল ফাটানো, আলতার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য বলা হয়। নিয়ম যাতে মানা হয় সেজন্য প্রবীণ সেবাইতদের নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার জন্য বলেন তিনি। সেইমতো সোমবার দুপুরে মন্দির কমিটি বৈঠকে বসেন। বেশকিছু সিদ্ধান্তের পাশাপাশি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। মন্দির কমিটির সভাপতি বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশ মেনে মঙ্গলবার থেকে শিলামূর্তি স্নানের পর ভোর সাড়ে ৫টায় সকলের জন্য খুলে দেওয়া হবে গর্ভগৃহের দরজা। প্রথম একঘণ্টা সাধারণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পুণ্যার্থী প্রবেশ করানো হবে। পরে বিশেষ লাইনে থাকা ভক্তদের প্রবেশ করানো হবে। এভাবেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর সাধারণ ও বিশেষ লাইনে থাকা ভক্তদের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। এবার থেকে গর্ভগৃহ ও বারান্দায় নারকেল ফাটানো, দেবী বিগ্রহে আলতা, অগরু দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।