আজ লোকসভা ভোটের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা । এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ১০০ কোটি ভারতীয় ভোট দিয়েছেন। কারা আসছেন ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এনিয়ে এখন টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিজেপি, কংগ্রেস না দুর্বল কোনো কোয়ালিশন? ভারতের নতুন সরকারে কারা আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের হিসেবটা কেমন হবে? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে এর? ভারতে যেমন এটি আলোচনার বিষয়, বাংলাদেশেও তাই৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং দীর্ঘদিনের। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের সরকার ও নীতির যে কোন ধরণের পালাবদলের প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। যে কারণে ভারতের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশিদের যথেষ্ঠ আগ্রহ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতে কারা ক্ষমতায় আসবেন, বাংলাদেশের মানুষের তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট যুক্তি আছে৷ কারণ বিজেপি আর কংগ্রেসের নির্বাচনি প্রচারে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রধান এই দুটি দলের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়েছে৷ তাই বিজেপি ক্ষমতায় এলে এবং নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে কূটনৈতিক সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন না আসলেও সম্পর্কের ভাষায় যে পরিবর্তন আসবে তা নিশ্চিত৷ আর এর সুযোগ নেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দলগুলোও৷ কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের আওয়ামী লিগ সরকারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ৷ এমনকি নেতাদের মধ্যেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ আছে৷ তাই কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় না থাকে আর ভারতে যদি বাংলাদেশ বিরোধিতা বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশেও ভারত বিরোধিতা বাড়বে৷ নরেন্দ্র মোদী একাধিক সমাবেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন, তা ভাবিয়ে তুলেছে এখানকার মানুষকে৷ তবে তাঁর এই কথা ভোটের জন্য, না তিনি নীতির দিক থেকেই বলেছেন, তা বুঝতে আরো সময় লাগবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের অনেক দেনা-পাওনার হিসাব আছে৷ সীমান্ত চুক্তি, জল চুক্তি, ট্রানজিট – এ সব নিয়ে কী হবে, তা নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নির্বাচনে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারে কতটা প্রভাবশালী হন তার ওপর-বলছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে ভারতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাদের উচিত, দেশটির মুসলিম নাগরিকদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতি আরও বেশি সহনশীল হওয়া। বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মুসলমানদের পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জনসংখ্যার হিসেবে প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলিম ভোটারের দেশ ভারতের লোকসভায় আনুপাতিক হারে তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগও তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন কেউ কেউ। তাই বাংলাদেশের মানুষের মাঝে অন্যতম আলোচনার বিষয়, ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি।
বাংলাদেশিরা মনে করেন, সিএএ বাস্তবায়নের পর ‘NRC’ কার্যকর হলে অসম ও পশ্চিমবঙ্গে বহু মুসলিম ভারতের নাগরিকত্ব হারাতে পারেন এবং এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ সীমান্তে। অপরদিকে, গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকায় বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী বা মোদী বিরোধী মনোভাব আরও প্রবল হয়েছে। যে কারণে ভারতের আগামী সরকারের নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি সরকারকে প্রত্যাশা করেন না বাংলাদেশের অনেকেই । বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুদ পলাশের ভাষায়, ভারতে মুসলমানদের প্রতি অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাব পোষণ করা, মুসলমানদের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখা ইন্দিরা গান্ধীর দল কংগ্রেসেরই ক্ষমতায় আসা উচিত। এতে ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দৃঢ় হবে, মুসলমানদের নিরাপদে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
তবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আহসান আহমেদ মনে করেন, ভারতে এমন সরকার থাকা উচিত যারা সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত দশ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনও পরিবর্তন আসেনি। উল্টো ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তঃ যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা চাই ভবিষ্যতে এটি যাতে অটুট থাকে সে জন্য নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারই আবার ভারতের ক্ষমতায় আসুক।
কেমন হবে হাসিনা- ভারত সম্পর্ক?
ভারতে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, তাতে ‘বাংলাদেশ নীতি’তে পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা নেই। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গেও সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের জনগন। কারণ কংগ্রেস এবং বিজেপি সব সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বন্ধুত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের সব দলের সরকারই শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখে। তবে মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার বহাল থাকলে, তিস্তা চুক্তি সম্পাদন ও গঙ্গা চুক্তির নবায়ন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে উদ্যোগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। মোদী -হাসিনা সরকারের আমলে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, স্থল সীমান্ত চুক্তি, সড়ক পথে ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতিসহ আরো বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে। এসব চুক্তির কারণে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়গুলোও অনেকটা নির্ভর করে মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের পুনরায় ক্ষমতায়নের উপর।
যা ভাবছেন রাজনীতিবিদরা
ড. শাম্মী আহমেদ এমপি, ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। মুক্তিযোদ্ধা কন্যা শাম্মী মনে করেন, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল নয়, ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের বন্ধু। সেখানে যাঁরাই ক্ষমতায় আসুক বাংলাদেশ বা তাঁর দল তাদের সঙ্গেই কাজ করবে। অতীতেও এমনই হয়েছে। ড. শাম্মী বলেন, ভারতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটা ঐতিহ্য রয়েছে। সেখানে জনগণ তাদের ভোট প্রয়োগের পরিপূর্ণ সূযোগ পান। এবং পছন্দের নেতা নির্বাচিত করার সূযোগ পান। আমাদের সম্পর্ক ভারতের জনগণের সঙ্গে এবং তাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে । তাই যাঁরাই নির্বাচিত হবেন বাংলাদেশ তাদের সঙ্গেই কাজ করবে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের বক্তব্যও পাওয়া গেল অনেকটা একই ধরনের। দলের ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের অনেক জায়গা। চাইলেই আমরা ভারতকে পাশ কাটাতে পারি না। সে দেশের সরকার বা জনগণকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। যে কারনে ভারতের সরকার বা জনগণের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে। সেটা যে রাজনৈতিক দলের সরকারই হোক না কেন। নিতাই রায় চৌধুরী মনে করেন, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিই ফের ক্ষমতায় ফিরবে। ক্ষমতায় ফিরে বাংলাদেশের কোনো বিশেষ দলকে নয়, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি নজর দেবার দাবি জানান এই বিরোধী নেতা। নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভারত প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক জোটকে সমর্থন দিয়েছে। এনিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ভারতের নতুন সরকার বাংলাদেশের জনগণের বিভ্রান্তি দূর করতে বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে উদ্যোগী হবেন আশা নিতাই রায় চৌধুরীর।