বাংলায় দেখতে দেখতে সাঙ্গ হল ৮ দফার ভোট পর্ব। লম্বা এই ভোট প্রক্রিয়ার জন্য কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলছেন অনেকেই। তবে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল আরোরা জানিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে উদ্বেগ জনক। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে হলে আট দফাতেই গোটা প্রক্রিয়া সাঙ্গ করতে হবে। বলাইবাহুল্য এত দফার ভোট আগে কখনও দেখেনি বঙ্গবাসী। তখন থেকেই রাজ্যের ভোটে কমিশনের তৎপরতা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। আবার কাকতালীয় ভাবে বঙ্গ ভোটের মাঝেই নির্বাচন কমিশনার হিসাবে মেয়াদ শেষ হয়েছে সুনীল আরোরার। তাঁর জায়গায় নতুন কমিশনার হয়েছেন সুশীল চন্দ্র।
২০১১ সালে রাজ্য রাজনীতি পরিবর্তন দেখেছিল। সেবার ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ২০১১ সালে যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটা বোধহয় ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের ফল দেখেই কিছুটা আন্দাজ করা গিয়েছিল। তার তুলনায় ২০১৬ সালের ভোট ছিল অনেকটাই ম্যাড়ম্যাড়ে। তবে ২০২১ সালের ভোট সেই তুলনায় একেবারে আলাদা। এমন হাইভোল্টেজ রাজনৈতিক লড়াই বঙ্গভোটে বিগত নির্বাচনগুলিতে কিন্তু দেখেনি রাজ্যবাসী। আর এই ভোটে রেফারির ভূমিকায় কমিশনের সক্রিয়তাও কিন্তু প্রথম থেকেই নজর কেড়েছে।
এবারের ভোট সব অর্থেই এককথায় নজির বিহীন। কমিশনের রোষানল থেকে বাদ যাননি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এর আগেই এই বাংলায় ভোট প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীর প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারির মত ঘটনা নেই। তবে এবার সেই অভিজ্ঞতারও সাক্ষী থেকেছে বঙ্গবাসী। গত ১২ এপ্রিল মুসলিম ভোট নিয়ে প্ররোচনামূলক মন্তব্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ভোটারদের উস্কানোর ‘অপরাধে’ ২৪ ঘণ্টার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কমিশন। তার আগে তৃণমূলনেত্রীকে দু'বার শোকজও করেছিল কমিশন। মমতার জবাবে সন্তুষ্ট না হয়েই এই পদক্ষেপ বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।
তবে তার আগেই অবশ্য মমতার সঙ্গে কমিশনের দ্বৈরথ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবারের নির্বাচনে। গত ১০ এপ্রিল চতুর্থ দফার ভোটে শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানোকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে ওঠে। তারপরদিন কোচবিহারে যাবেন বলে ঘোষণা করেন মমতা। কিন্তু তার আগেই কমিশন জানিয়ে দেয়, কোচবিহারে ৭২ ঘণ্টার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এতে পরিকল্পনা বদলাতে হয় মমতাকে। সেই সময় কমিশনকে মোদী কোড অব কনডাক্ট বলে কটাক্ষ করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী।
তবে কেমল শাসক শিবিরই নয় বিজেপির রাজ্য সভাপতিও বাঁচতে পারেননি কমিশনের রোষানল থেকে। শীতলকুচি নিয়ে মন্তব্যের জেরে মমতার মতই দিলীপ ঘোষের প্রচারে ২৪ ঘণ্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন।
বাদ যাননি বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহাও। প্ররোচনামূলক বক্তব্য রাখার জন্য হাবড়ার বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহার প্রচারে ৪৮ ঘণ্টার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল কমিশন।
সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি না হলেও কমিশনের নজর থেকে কিন্তু বাঁচেননি নন্দীগ্রামের বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীও। ভোটপ্রচারে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ ওঠায় শুভেন্দু অধিকারীকে নোটিশ পাঠিয়েছিল কমিশন।
আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর প্রচারেও ২৪ ঘণ্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন।
সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের জেরে আরামবাগের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা মণ্ডলের ভোটপ্রচারেও ২৪ ঘণ্টার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন।
রাজ্যে আদর্শ আচরণ বিধি লাগু হয়ে যাওয়র পর থেকেই একাধিক পুলিশ কর্তা থেকে শুরু করে জেলাশাসককে বদলি করতে দেখা গেছে কমিশনকে। ২১-এর নির্বাচনে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয় রাজ্য নিরাপত্তা উপদেষ্টার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে।
অনেকেই রাজ্যে করোনা বৃদ্ধির জন্য কমিশনের আট দফার ভোটপর্বকেই কাঠ গড়ায় তুলছেন। এমনকি মাদ্রাজ হাইকোর্টের তিরস্কারও জুটেছে কমিশনের কপালে। তবে এবারই প্রথম দেখা গেছে ৭২ ঘণ্টা আগে ভোটের প্রচার বন্ধ করেছে কমিশন। পঞ্চম দফা থেকেই এই নিয়ম লাগু করা হয়েছে রাজ্যে। রাজ্যে বেলাগাম ভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ষষ্ঠ দফার ভোটের দিন সব রোড শো-র্যালিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কমিশন। বাইক, সাইকেল র্যালিতেও জারি হয় নিষেধাজ্ঞা।
দেশের করোনা পরিস্থিতির জন্য কার্যত কমিশনকে দায়ি করেছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট। এই আবহে ২ মে ভোট গণনা দেশের ৪টি রাজ্য ও ১টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। তার আগে কমিশন জানিয়েছে এবার কোনও রাজনৈতিক দল বিজয় মিছিল বার করতে পারবে না। এবারের ভোটে বারবার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে এটাও ঠিক এবারের ভোটে কমিশনের কর্মপদ্ধতি চমক দিয়েছে আম জনতাকে।