কলকাতা সংলগ্ন প্রতিবেশী হাওড়া জেলা এতদিন ছিল তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। ১৬টি বিধানসভা আসনের এই জেলা ২০১৬ সালে পেয়েছিল ৩ জন মন্ত্রী। এঁদের মধ্যে থেকে সম্প্রতি সাময়িক রাজনৈতিক সন্ন্যাসের কথা ঘোষণা করে দলত্যাগ করেছেন লক্ষ্মীরতন শুক্লা। বেশ কয়েকদিন ধরেই বেসুরো বাজছেন মমতা মন্ত্রিসভার আরও এক পরিচিত মুখ রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দু বিদায়ের পর তাঁর বিজেপি গমন নিয়েও এখন জোর আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। এই আবহে হাওড়ায় ঘাসফুল শিবিরে অদূর ভবিষ্যতে বড়সড় ভাঙন ধরতে চলেছে বলেই আশঙ্কা করছেন রাজনৈকি বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের আশঙ্কার স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। এই আবহে আগামী ৩১ জানুয়ারি হাওডায় আসছেন অমিত শাহ। মেদিনীপুরে তাঁর জনসভায় রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বিধায়ক, নেতা, সাংসদ সহ ৪২ জনকে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। এবার হাওড়াতেও অমিত শাহের সভায় তেমনি কোনও চমক থাকতে চলেছে কিনা তা নিয়েই রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়েছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুর কলেজ মাঠে অমিত শাহ যখন সভা করেন তাতে বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণ মোটামুটি সব জেলারই কোনও না কোনও প্রতিনিধি গেরুয়া শিবিরে নাম লেখান। কেবল মাত্র দক্ষিণবঙ্গের ২টি জেলা থেকে সেদিন কেউ বিজেপিতে যোগ দেননি। তার মধ্যে একটি যেমন নদিয়া তেমনি আরেকটি হাওড়া। অমিত শাহের আসন্ন বাংলা সফরে সেই খরা কাটবে বলেই আশাবাদী পদ্মশিবির।
শুভেন্দু অধিকারী দল ছাড়ার আগে থেকেই বেসুরো গাইছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন হাওড়ায়, আর তিনি ডোমজুড়ের বিধায়ক। তারপরও রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক বৈঠকে গরহাজির থেকেছেন রাজীব। হাওড়া জেলা কো-অর্ডিনেটর তথা বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যাকে প্রকাশ্যেই বেশ কয়েকবার তৃণমূলের সমালোচনা করতে দেখা গেছে। রাজীবের মান ভঞ্জনে পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে ফিরহাদ হাকিম সকলেই ময়দানে নেমেছেন। কিন্তু তাঁর মনের তল এখনও কেউ পেয়ে উঠতে পারেননি। আর এই আবহেই উত্তর হাওড়ার বিধায়র লক্ষ্মীরতন শুক্লার মন্ত্রিত্ব ও জেলা সভাপতির পদ থেকে সরে যাওয়া নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শোনা যাচ্ছে হাওড়া জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়ের সঙ্গে রাজীব ও লক্ষ্মী দু'জনেরই সম্পর্ক বর্তমানে শীতল। এমনকি রাজীবের সঙ্গে অরূপের মতপার্থক্য বহুবার প্রকাশ্যে এসেছে। রাজীবকে নিয়ে কটাক্ষ করতেও শোনা গিয়েছে অরূপকে। সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে উপস্থিত হতে দেখতে পাওয়া যায়নি। এই আবহেই তৃণমূলের ২৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতেও হাওড়া সদরে দলের অফিসে অরূপের পাশে দেখা যায়নি লক্ষ্মী ও রাজীবকে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত ছিলেন সাংসদ প্রসূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
কেবল রাজীব বা লক্ষ্মীই নয়, বেসুরো বাজতে শুরু করেছেন, দলের প্রবীণ বিধায়ক জটু লাহিড়ী, প্রবীণ নেতা বাণী সিংহ রায় থেকে হাওড়ার প্রাক্তন মেয়রও । লক্ষ্মীরতন শুক্লা পদত্যাগ করতেই দলের প্রতি একরাশ ক্ষোভ উগরে প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগে সিলমোহর দিয়ে বলেন,“দলটা একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।” রথীন চক্রবর্তীর কথায়, “শেষ ১০ বছরে হাওড়ায় কোনও উন্নয়ন হয়নি। এবিষয়ে রাজ্য নেতৃত্বকে কোনওকিছু জানিয়ে কোনও হয় না। ওরা পাথর। ওদের জানানো আর দেওয়ালকে জানানো এক।” লক্ষ্মীরতন শুক্ল দল ছাড়ায় ক্ষুব্ধ বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়াও। লক্ষ্মীকে দলের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিল না বলে অভিযোগ তুলে কার্যত লক্ষ্মীর পাশেই দাঁড়িয়েছেন বৈশালী। এর আগেও বৈশালীকে দলের প্রতি ক্ষোভ উগরাতে দেখা গিয়েছিল। নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রী পর বিস্ফোরক হতে দেখা গেছে তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত প্রধানকেও। জগদীশপুরের পঞ্চায়েত প্রধান গোবিন্দ হাজরা সাংবাদিক বৈঠকে নাম করে সরাসরি আক্রমণ করেছেন মন্ত্রী অরূপ রায়কে। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গিমিক বলে তোপ দেগেছেন তিনি। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত ভরাডুবি হবে বলে তিনি আগাম ঘোষণাও করেছেন।
২০২১-এর বিধানসভা ভোট কড়া নাড়ছে দুয়ারে। যখন নির্বাচনে লড়তে সবার সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার কথা, তখন জেলা তৃণমূলের অন্দরে এই ছাই চাপা আগুন প্রশ্ন তুলছে, হাওড়া জেলা তৃণমূলের ভাঙন রেখা কি সম্ভব? তৃণমূল কি আরও ভাঙবে আসন্ন নির্বাচনের আগে? তার মধ্যে চলতি মাসের শেষেই হাওড়ায় সভা করার কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর। তা নিয়েই এখন জল্পনা বাড়ছে। হাওড়ায় যে তিন নেতা-নেত্রী এখন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে তাদের নিয়ে উৎসাহ গোপন করছে না বিজেপিও। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাবরই প্রশংসা করে এসেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। লক্ষ্মীর ইস্তফা প্রসঙ্গও বিজেপির দরজা খোলা জানিয়েছেন তিনি। এই আবহে আগামী ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি ফের বঙ্গ সফরে বিজেপির চাণক্য অমিত শাহ। ৩০ তারিখ বনগাঁয় সভা করার পর ৩১ তারিখ তিনি হাজির হবেন হাওড়ায়। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বে একাংশ এখনই দাবি করতে শুরু করেছে, মেদিনীপুরের কলেজ মাঠের মতই চেহারা নিতে পারে শাহের হাওড়ার জনসভা। অমিত শাহের সভা হয়ে উঠতে পারে যোগদান মেলা। তব্যি সত্যি সেটা হচ্ছে কিনা বঙ্গ রাজনীতির সেই নতুন অধ্যায় দেখার জন্য আম জনতাকে আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে।