একটা সময় ছিল যখন মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা অর্থাৎ 'রুপি'-র অবস্থা বেশ ভাল ছিল। কিন্তু যত সময় এগোচ্ছে, টাকা দুর্বল থেকে দুর্বল ও ডলার আরও শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বার একটি পোস্টকার্ড বেশ ভাইরাল হয়েছে।
হিন্দিতে ভাইরাল হওয়া সেই পোস্টকার্ডে দাবি করা হয়েছে, ১৯১৭ সালে ১ টাকা সমান ১৩ মার্কিন ডলার ছিল। স্বাধীনতার সময় ১ টাকা ও এক ডলার ছিল সমকক্ষ। কিন্তু তারপর থেকে টাকার দামের পতন হতে হতে তা এখন ডলার প্রতি ৭৪ টাকায় এসে ঠেকেছে। টাকার মূল্যের এই পতনের জন্য দায়ী করা হয়েছে রাজনেতাদের।
ইন্ডিয়া টুডে-র অ্যান্টি ফেক নিউজ ওয়ার রুম (আফয়া) তদন্ত করে পেয়েছে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত এই পোস্টকার্ডের দাবিটি বিভ্রান্তিকর। বর্তমান সময়ে ডলার প্রতি টাকার মূল্য ৭৪ টাকার আশেপাশে হলেও ১৯১৭ সালে ও স্বাধীনতার সময় টাকার যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।
আফয়া তদন্ত
টাকার দাম কীভাবে কমেছে বা বেড়েছে, এই বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে সবার প্রথম আমরা আজকের দিনে ডলার প্রতি টাকার মূল্য কত, সেটা জানার চেষ্টা করি।
ইকনোমিক টাইমসের একটি ইনডেক্সের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, আজকের দিনে, অর্থাৎ ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ১ ডলারের মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ৭৪.৫২ টাকা ধার্য করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয় যে পোস্টকার্ডে বর্তমান সময়ে টাকার মূল্য সম্পর্কে যে দাবি করা হয়েছে তাতে কোনও ভুল নেই।
এবার চলে আসা যাক স্বাধীনতার সময়ে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে। পোস্টকার্ডের দাবি, ১৯৪৭ সালে ১ ডলার ও ১ টাকার মূল্য সমান-সমান ছিল। কিন্তু এই বিষয়ে কিওয়ার্ড সার্চ করায় আমরা বিখ্যাত ভ্রমণ সংক্রান্ত ওয়েবসাইট থমাসকুকের একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই যেখানে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কতটা বেড়েছে বা কমেছে, সেই তথ্য দেওয়া ছিল। সেখানে লেখা হয়, ১৯৪৭ সালে ১ মার্কিন ডলার মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ছিল ৩.৩০ টাকা।
এই সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে আমরা ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটেও যাই। সেখানে "ফ্রিকুয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চনস" বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সালের মাঝে প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারের মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ছিল ৩৩১.৭৫ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি এক ডলারের পরিবর্তে সেই সময় ৩.৩২ টাকার মতো পাওয়া যেত। এর থেকে কার্যত প্রমাণ হয়ে যায় যে স্বাধীনতার সময় ডলার ও টাকার সম-মূল্যের দাবিটি ভুল।
এ বার প্রশ্ন হচ্ছে ১৯১৭ সালে এক টাকার মূল্য কি সত্যি ১৩ মার্কিন ডলার ছিল? এ ক্ষেত্রে উত্তর খোঁজা কিছুটা জটিল ছিল কারণ ১৯৪৭ সালের পূর্বে ব্রিটিশ শাসনে ভারতে ব্রিটেনের মুদ্রাও ব্যবহার হতো। বিষয়টি নিয়ে কিওয়ার্ড সার্চ করার পর আমরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে ১৯৩৫ সালের আগে ভারতের কারেন্সি, এক্সেঞ্জ ও ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট দেখতে পাই।
সেই রিপোর্টে প্রকাশ পায়, ১৯১৭ সালের অগস্ট মাসে রুপির মূল্য '১ এসডি' হিসেবে নির্ধারণ করা হতো। কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে একটি ব্রিটিশ ওয়েবসাইটের মারফৎ আমরা জানতে পারি, এক্ষেত্রে "এস"-এর অর্থ হল শিলিং এবং "ডি"-এর অর্থ পেনি। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এক পাউন্ডকে কম পরিমাণ অর্থ বোঝাতে শিলিং এবং পেনি-র ব্যবহার করা হতো।
১৯৪৭ সালে '১ ডি' হত ১২ পেনি মিলিয়ে। এবং 'এস' হত দুই পেনি নিয়ে। সেই হিসেবে ১ এসডি-কে শুধুমাত্র পেনিতে ভাগ করলে তা দাঁড়ায় ১৪ পেনিতে। ১৪ পেনিকে যখন আমরা পাউন্ডে হিসেব করি তখন তা হয় ০.৬৬ পাউন্ড। ১৯১৭ সালের বাজারমূল্য অনুযায়ী, ১ পাউন্ডের পরিবর্তে ৪.৭৬ মার্কিন ডলার পাওয়া যেত। সেই হিসেবে ০.৬৬ পাউন্ডকে ডলারে পরিবর্তন তা দাঁড়ায় ০.১৩৪ ডলার। অর্থাৎ, এক টাকার পরিবর্তে ১৯১৭ সালে ডলারের মূল্য ছিল ০.১৩৪।
সূতরাং, এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে ভাইরাল পোস্টকার্ডের যেমনটা দাবি করা হয়েছে, তা সত্যি নয়।
১৯১৭ সালে ভারতীয় মুদ্রায় ১ টাকার মূল্য ১৩ মার্কিন ডলার ছিল। ১৯৪৭ সালে ১ টাকা ও ১ ডলার ছিল সমান-সমান।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুদ্রায় ১ টাকার মূল্য ০.১৩৪ ডলার ছিল। ১৯৪৭ সালে ১ ডলারের সমান ছিল ৩.৩২ টাকা।